“আগেকার দিনে চৈত্রমাস পড়িলেই গাজনে সন্ন্যাসীদের বড় হুড়োহুড়ি পড়িত। গাজনের দিন তারা ঢাক বাজাইয়া রাস্তা দিয়া যাইত। সেই সময় পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা রাস্তার ধূলায় কাঠি দিয়া একটা দাগ টানিয়া দিত। তারপর লোকে প্রশ্ন করিত যথা-' শুনরে সন্ন্যাসীভাই আমার বাখান/ এরন্ড আর থাম খুঁটি, ভেরেন্ডার বেড়া,/ তার মাঝেতে পড়ে আছে মস্ত এক নোড়া।/ বাটনা বাটিতে শিবের পুটকির হইল ক্ষয় / সেই শিবকে গড় করলে কি পুণ্য হয়?' প্রশ্নের উত্তর দিলে দাগ মুছিয়া যাইতে দেওয়া হইত।”
সেকালের গাজনের এমন বর্ণনা দিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত। শহর কলকাতার গাজনের আর এক বর্ণনা আছে কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখায়-
“১২০২ সাল। কলকাতা সহরের চারদিকেই ঢাকের বাদ্দি শুনা যাচ্ছে, চড়কীর পিঠ সড় সড় কচ্চে, কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বটি প্রস্তুত কচ্চে- সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নুপূর, মাথায় জরীর টুপী, কোমোরে চন্দ্রহার আর সেপাইপেড়ে ঢাকাই শাড়ী মালকোচা করে পরা, ছোপানে তারকেশ্বরে গামছা হতে, বিল্বপত্র বাঁধা সূতা গলায় যত ছুতর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাঁসারীর আনন্দের সীমা নাই-'আমাদের বাবুদের বাড়ী গাজন'।”
বাংলা সালের শেষ মাস চৈত্র। চৈত্রমাসের শেষ দিনটি হল চৈত্রসংক্রান্তি। পুরনো বৎসরকে বিদায় দেবার উৎসবটিই হল চড়ক যা কিনা বাঙালি হিন্দুসমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ লোক উৎসব। এই উৎসবটি কিন্তু অনেক কালের নয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সহ আরও কিছু পুরাণকথায় চৈত্র মাসে শিব পুজো র কথা আছে। আছে পুজো উপলক্ষে নাচ- গানের কথাও। কিন্তু চড়কের কোনও উল্লেখ সেখানে নেই। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে গোবিন্দানন্দের ' বর্ষক্রিয়াকৌমুদী' এবং রঘুনন্দনের 'তিথিতত্ত্ব'-র মধ্যেও চড়ক বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে সমাজের এক শ্রেণীর মধ্যে এই ধরণের উৎসব পালনের রীতি ছিল। 'ধর্মমঙ্গল' কাব্যে রানি রঞ্জাবতীর ধর্মঠাকুরকে তুষ্ট করার জন্য গাজন করার উল্লেখ আছে।
জনশ্রুতি এই যে, সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। যে শিব বৎসরের অন্যান্য দিনে ব্রাহ্মণদের দ্বারা পূজিত হন তিনি বর্ষশেষে অন্ত্যজদের পুজো গ্রহণ করে প্রকৃত অর্থে গণদেবতা হয়ে ওঠেন। শিব ছাড়াও নীলের গাজন, আদ্যার গাজন, ধর্মের গাজন ইত্যাদি গ্রামীণ জনজীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলত। কোনও কোনও পন্ডিত একে জনসাধারণের উৎসব অর্থাৎ গাঁয়ের বা গ্রামের, জন অর্থাৎ পাঁচজনের উৎসব বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
কেউ বলেছেন, জনগণের চিৎকার বিপুল বাদ্যোদমে গর্জন থেকেই সম্ভবত গাজন শব্দটির জন্ম। উৎস যাই হোক বাংলাদেশের জনজীবনে এর প্রভাব সুগভীর। চৈত্র মাস থেকে সূর্যের প্রখর তেজে বাংলার শ্যামলিমা উধাও হতে থাকে। সেই সময় বৃষ্টির আশায় ও সূর্যের তাপ কমার আশায় কৃষিভিত্তিক সমাজে এই উৎসবের শুরু। সাধারণত গ্রামীণ শিবমন্দিরেই এই উৎসব হয়। মূলত শিবকে কেন্দ্র করে গাজন হলেও সূর্যদেবতা, যিনি বাংলার গ্রামে ধর্মঠাকুরের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছেন, তাঁকে ঘিরেও গাজন হয়। উৎসব তিনদিনের হলেও এর শুরু হত এক মাস আগে। সংক্রান্তির মাসখানেক আগে থেকে গ্রামের যারা গাজনের সন্ন্যাসী হতে আগ্রহী বা যাদের মানত থাকে তারা স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে, উত্তরীয় বা উতুরী ও একখন্ড বেত ধারণ করে। নিজের গোত্র ত্যাগ করে তারা এই একটি মাস শিবগোত্র নিয়ে থাকে। গাজনের এই সন্ন্যাসীদের বলা হয় ভক্ত্যা। যে কেউ ভক্ত্যা হতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো জাতিভেদ নেই। তবে ভক্ত্যাদের অত্যন্ত সংযমের জীবন যাপন করতে হয়। হবিষ্যান্ন গ্রহণ, ব্রহ্মচর্যপালন, চুল দাড়ি না কাটা, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা, বাড়ির অন্নজল না খাওয়া ইত্যাদি নিয়ম অত্যন্ত কঠোর ভাবে পালন করতে হয়। গাজনকে ঘিরে একটি কাহিনি আছে। কথিত আছে, পুরাকালের রাজা বাণ ছিলেন অন্ত্যজ শ্রেণীর শিবভক্ত। তাঁর পরমাসুন্দরী কন্যা ঊষার সঙ্গে কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের সঙ্গে প্রণয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে ক্ষুব্ধ রাজা অনিরুদ্ধকে হত্যা করতে উদ্যত হলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের আঘাতে রাজা বাণের দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলেন। মৃত্যু পূর্বে রাজা বাণ বিষ্ণুর কাছে এই বর লাভ করেছিলেন যে অন্ত্যজ কন্যা ঊষা, যাদবদের উত্তরসূরীদের গর্ভে ধারণ করবে। আর বছরের একটি দিনের একটি বিশেষ তিথিতে যেন সমাজের অপাঙক্তেয়রাও সমাজে শ্রদ্ধার আসনে লাভ করে। সেই বিশেষ তিথিটিই গাজনের তিথি।
গাজনকে কেন্দ্র করে একাধিক লোকগান গাওয়া হয়। এর মধ্যে 'অষ্টক' গান উল্লেখযোগ্য। 'অষ্টক' গানের নামকরণ নিয়ে 'নানা মুনির নানা মত'। চৈত্র সংক্রান্তির সময় শিব ভক্তরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই গান গেয়ে চাল, ডাল, টাকা ইত্যাদি পেত। আটটি অধ্যায়ে ভাগ করে এই গান গাওয়া হত বলে এর নাম 'অষ্টক'। কোনও কোনও অষ্টক গায়ক মুখোশ পরত, কেউ রং মাখত। গানের সঙ্গে ঢোল, কাঁসি বাজত। আজ এই গান বিলুপ্তির পথে। মালদহ, রাজশাহী অঞ্চলে গাওয়া হয় গম্ভীরা গান। আগেকার দিনে দু ধরনের গম্ভীরা গাওয়ার রীতি ছিল। আদ্যের গম্ভীরা ও পালা গম্ভীরা। দেবতাকে কেন্দ্র করে যে গান তা হল আদ্যের গম্ভীরা আর পালা গম্ভীরায় থাকত সামাজিক সমস্যার গীতরূপ। আদ্যের গম্ভীরায় পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত জন্মকথার পর জীব, কপিলা ধেনু, পুজো র ঘট- ধুবচি, ঘাট, ঢাপ্রকের কাঠি ইত্যাদির সৃষ্টি ছৈকাহিনী পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গে চৈত্রসংক্রান্তির গাজন উপলক্ষ্যে কালীনাচ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অসুরবধ উপলক্ষ করে কালীর নাচ এর মূল উপজীব্য।
চড়কের আগের দিন নীলচন্ডিকার বা নীল পরমেশ্বরীর পুজো হয় যা জনসাধারণ নীলপুজো বা নীলষষ্ঠী বলে থাকে। মায়েরা সন্তানের মঙ্গলকামনায় নীলের উপোস করে থাকেন। নীলকন্ঠ শিবের সঙ্গে নীলাবতীর বিবাহকে স্মরণ করে গ্রামীণ জনজীবন এই উৎসবে পালন করে এসেছে। নীলের পুজো র দিনে অনেক অঞ্চলে একজন শিব সাজে, সঙ্গে দুজন সাজে সখী। এরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গেয়ে, বাজনা বাজিয়ে নেচে গাজনের গান গায়। এদের নীল পাগলার দল আর এদের গানকে নীলের গান বলা হয়। সারাদিন ঘুরে যা তারা পায় তাই দিয়ে হয় পুজো । কোনও কোনও অঞ্চলে ভীষণ আকৃতির, অশ্বারূঢ়, নীলবর্ণ নীল নামে এক পুরুষ দেবতার পুজো ও হত। কোথাও আবার গম্ভীর নামে এক বাতাসের মতো বেগবান, ত্রিনেত্রধারী এক দেবতার পুজো হয়। কোথাও দিগম্বর জটাধারী 'হাজরা' নামে এক দেবতার আরাধনাও করা হয়। এঁকে মহাদেব বলেই উল্লেখ করা হয়। এই পুজো অর্চনায় কোনও উচ্চবর্ণের পুরোহিতের প্রয়োজন পড়ে না।
আসলে গাজন বা নীলের পুজো অঞ্চলভেদে এক এক রকমের হয়। গাজনের যারা মূল উপাসক অর্থাৎ ভক্ত্যারা শিবের অনুচর সাজে। শিব নীলকন্ঠ। গাজনের সঙ্গেই হয় নীলের পুজো। সংস্কৃতে যাকে বলে 'কালার্করুদ্র পুজো'- অর্থাৎ যে অর্ক কালস্বরূপ অর্থাৎ ভয়ংকর, তাঁর পুজো। তাঁর দেহের বর্ণ, ঔজ্জ্বল্য আর অট্টহাসি উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, চড়কের আচার অনুষ্ঠানগুলি "মূলত গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের প্রধানতম ও আদিমতম ভয়-বিস্ময়-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত।" চৈত্র সংক্রান্তির মূল আকর্ষণ এই চড়ক পুজো । এই উৎসবের শিকড় আছে কৃষিজীবী সমাজে। তাই বাংলার কৃষিপ্রধান অঞ্চলেই চড়কপুজো করা হয়। চড়ক গাছ শিবমন্দিরের কাছে কোনো পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। সাধারণত ২০- ২৫ ফুট উঁচু একটি শাল গাছের খুঁটিকে চড়ক গাছ বলে। জলে ডোবানো সেই খুঁটি সংক্রান্তির আগে জল থেকে তুলে এনে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে চড়কতলায় পোঁতা হয়। একে বলে "গাছ জাগানো"। জলভরা একটি পাত্রে রাখা হয় "পাটা" বা এক খন্ড লম্বা কাঠ। একে বলে বুড়োশিব। চড়কের দিন বুড়োশিবের পুজো করা হয়। চড়ক গাছের মাথায় একটি কাষ্ঠদন্ড রাখা হয়। এই কাষ্ঠখন্ডটির মধ্যে এমনভাবে ছিদ্র করা হয় যাতে চড়কগাছকে কেন্দ্র করে কাঠটি শূন্যে গোল হয়ে ঘুরতে পারে। কাঠ থেকে ঝোলানো বাঁকানো লোহার কাঁটায় পিঠ বিদ্ধ করে সন্ন্যাসীরা ঝুলে থাকত। অনেকসময় কোমরে গামছা বা কাপড় বেঁধে তাতে লোহার কাঁটায় গেঁথে ঝোলে, পাক খায়। কাষ্ঠখন্ডটি চক্রাকারে ঘোরানো হয় বলে একে চড়ক ঘূর্ণি বলা হয়। চড়ককাঠে ঝোলাকে কেউ কেউ বলে বড়শি সন্ন্যাস। যে চড়কগাছে পিঠ ফুঁড়ে সন্ন্যাসীরা ঘোরে তাকে বলে "গজারি" যা কিনা শিবের অন্য নাম। শিবকে তুষ্ট করার জন্যই সন্ন্যাসীরা চড়কে ঘোরে। আর এই ঘুরন্ত সন্ন্যাসীদের আশীর্বাদ নেবার জন্য শিশুদের মাথায় সন্ন্যাসীদের করস্পর্শ করানোর চেষ্টা করে অভিভাবকেরা। কখনও কখনও সন্ন্যাসীরা চড়কে পাক খেতে খেতে বাতাসা, বেশ, কাঁচা আম ইত্যাদি ছুঁড়ে দিতে থাকে। ওই ফল যে পায় সে নাকি ভাগ্যবান। এছাড়া জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটা, কাঁটায় শরীর বিদ্ধ করা ইত্যাদি নানাভাবে শরীরকে কষ্ট দিয়ে শিবকে তুষ্ট করার চেষ্টা চলে। চড়কের অন্যতম অঙ্গ হল কৃচ্ছসাধন। সন্ন্যাসীরা নিজেদের শরীরকে নানাভাবে কষ্ট দেয়-কখনও শরীরে লৌহশলাকা ঢোকায়, কখনও উঁচু বাঁশ থেকে আগুনে ঝাঁপ দেয়, কখনও কাঁটার ওপর ঝাঁপ দেয়, কখনও আবার খোলা বটির ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। সাধারণত সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষই এই পুজো য় অংশ নিয়ে আনন্দ করে। খুব জাঁকজমক সহযোগে বাজনা বাজিয়ে সন্ন্যাসীরা নানান মুদ্রায় দেবতাকে একাধিকবার প্রণাম করে।
এই নৃশংসতা দেখে ইংরেজ আমলে আইন করে এর নানা ভয়ংকর আচরণ বন্ধ করা হয়। চড়ককাঠ থেকে ছিটকে পড়ে একাধিকবার অনেক সন্ন্যাসীর মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও এই প্রথার প্রতি জনমানুষের বিশ্বাস আজও আছে। দুই বাংলার গ্রামীণ লোকজীবনের নিজস্ব উৎসব চড়ক আর গাজন। অনেকের কাছে চড়ক গাছ প্রকৃতিস্বরূপা। প্রকৃতি জননীর আদিরূপ এই চক্র। প্রকৃতির চক্রে আবদ্ধ হয়ে শূন্যে বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়মান মানবজাতি। চড়কের চক্রের যেন কালচারের প্রতীক। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে চড়ক বাঙালি জনসত্তার যে এক নিজস্ব উৎসবে পরিণত হয়েছিল তার প্রমাণ আছে সেকালের ইয়োরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ছবিতে আর ফ্যানি পার্কস সহ আরও অনেকের লেখায়। বাংলায় পাল আমলের বৌদ্ধধর্ম শশাঙ্কের পর মূলধারা থেকে সরে গিয়ে পরবর্তী সময়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের রূপ নিয়ে মিশে গিয়েছিল চড়কের উৎসবে। তন্ত্র তার গূহ্য গূঢ় গোপনীয়তার অবরোধ থেকে নেমে এসেছিল জনমনের কাছে। যে কারণে এত নৃশংসতা সত্ত্বেও লোক জীবনের সঙ্গে এর যোগ এত নিবিড় ছিল যে ছোটরা ছড়া কাটত এই বলে "আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই/ একটি দুটি পয়সা পেলে বাড়ি ফিরে যাই"।
চড়ক বা গাজন গ্রামজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও শহর কলকাতায় এর প্রভাব কম ছিল না।একালে, এই সেদিনও "বাবা তারকাদের চরণে সেবা লাগে " বলে হু়কার দিয়ে সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা নিত। শিব দুর্গার সেজে নাচ দেখিয়ে পয়সা নিয়ে মেতে সন্ন্যাসীরা। আজ সেসব প্রায় বিলুপ্ত। সেকালে কিন্তু কলকাতার নানা প্রান্তে চড়কের আয়োজন হত। বসত চড়কের মেলা। আজ ও অবশ্য তার ক্ষীণ রেশ আছে। কলকাতা আর লাগোয়া হাওড়ার নানা অঞ্চল থেকে সঙ বেরত।
সেদিনের বিবরণ ধরে রেখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ-"চিৎপুরের বড় রাস্তায় মেঘ কল্লে কাদা হয়- ধূলোয় ধূলো; তার মধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েছে। প্রথমে দুটো মুখে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশ বেঁধে কাঁধে করেছে- কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ী বাজাতে বাজাতে চলেছে- তার পেচোনে এলোমেলো নিশানের শ্রেণী। মধ্যে হাড়ীরা দল বেঁধে ঢোলের সঙ্গতে ' ভোলা ব্যোম ভোলা বড় রঙ্গিলী/ লেংটা ত্রিপুরারি শিরে জটাধারী ভোলার গলে দোলে হাড়ের মালা' ভজন গাইতে গাইতে চলেছে। তাঁর পেচোনে বাবুর অবস্থামত তকমাওয়ালা দারোয়ান, হরকরা সেপাই। মধ্যে সর্বাঙ্গে ছাই ও খড়ি মাখা, টিনের সাপের বলার টুপী মাথায়, শিব ও পার্বতী সাজা সং। তার পেচোনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকি ফুঁড়ে ধূনো পোড়াতে পোড়াতে নাচতে নাচতে চলেছে। পাশে বেতের দিবে হাতে বাণ ফুঁড়ে চলেছে। লম্বা লম্বা ছিপ, উপরে শোলার চিংড়িমাছ বাঁধা। সেটাকে সেট ঢাকে ড্যানাক ড্যানাক করে বাজাচ্ছে। পেছনে বাবুর ভাগ্নে, ছোট ভাই বা পিসতুতো ভেয়েরা গাড়ী চড়ে চলেছে- তারা রাত্রি তিনটার সময় উঠেচেন, চোক লাল টকটক কচ্চে, মাথা ভবানীপুরে, কালী ঘেঁটে ধূলোয় ভরে গিয়েছে।"
কালীঘাট, ডোমতলা, কুমোরটুলি, বেনিয়াটোলা, আহিরীটোলা, কাঁসারীপাড়া, জেলেপাড়া। লোহাপটি, খিদিরপুর, তালতলা ইত্যাদি এলাকা ছাড়াও হাওয়ার শিবপুর, খুরুট ইত্যাদি অঞ্চল থেকে সঙ বেড়োত। রঙ্গ রসিকতা ছাড়াও সমাজের নানা অসঙ্গতিও তুলে ধরা হত এই সঙ-এর মধ্যে। বাবু কালচারের নিছক আমোদে মিশে গেল সমাজ সচেতনতার ছবিও। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র চুরি গেল। জেলেপাড়ার সঙ বলল-"বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে/ সখীরা নেকী নাকি গড়ল ফাঁকি/ কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে/ বিদ্যা সর্ব্ববিদ্যা অধিকারী/ দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী"।
এভাবেই প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি নানাভাবে রূপ বদলে গাজন হয়ে উঠেছে তারাপদ সাঁতরা কথিত " বাংলার প্রকৃত গণ উৎসব"।