এক বৌদ্ধিক স্রষ্টা রাহুল সাংকৃত্যায়ন

বিদ্বান সর্বত্র পূজিত হন, একথা আমাদের মরমে বসে গিয়েছে, বৌদ্ধিক স্রষ্টা রাহুল সাংকৃত্যায়নের আজ মৃত্যুদিন। ১৮৯৩ সালে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম; পান্ডাহাতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে কেদারনাথ পাণ্ডের জন্ম হয়েছিল। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজনকৃষক। শিশু কেদারকে নিয়ে তাঁর মাতামহের খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র বলে কথা। তিনি ছিলেন এক জন পুরবিয়া সৈন্য, সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি করতেন। অদূর ভবিষ্যতেই ভারত বহুবিধ পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে চলেছে, বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। নাতিকে নিজামাবাদের উর্দু মাদ্রাসায় পড়ানোর বন্দোবস্ত করলেন এমন এক সময়ে, যখন মাদ্রাসাগুলোই ছিল গ্রামাঞ্চলে শিক্ষালাভের একমাত্র স্থান। গ্রাম্য পাঠশালা থেকেই শুরু হয়েছিল যাত্রা, হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি,  সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি,তিব্বতি ও রুশ ভাষা ছিল নখদর্পনে।

সরকারি বৃত্তির অভাবে রাহুলের প্রথাগত শিক্ষা শেষ হল উর্দু মিডল স্কুলেই।অন্য আরও অনেক পুরবিয়ার মতোই কেদার বাড়ি ছাড়লেন, তখন তাঁর তেরো বছর বয়স।এলেন আমাদের এই শহরে। কলকাতার রাস্তায় তিনি তখন জীবন, জ্ঞান আর
অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বেড়াচ্ছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য নানান কাজ করেছেন,হয়েছেন ফেরিওয়ালা, রেলের হেল্পার, কখনও বা কারও রাঁধুনিও।কলকাতার পথের অভিজ্ঞতা তাঁকে একেবারে পালটে দিল। এই শহরই তাঁকে রাজনীতি-সচেতন করে তুলল, সজাগ করল রোজকার বেঁচে থাকার লড়াই নিয়েও। রাস্তার সাইনবোর্ড, পোস্টার দেখে দেখে তিনি ইংরেজি পড়তে শিখলেন। আর এই সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝলেন, তাঁর না-দেখা নতুন যে জগৎ পড়ে আছে, তাকে তিনি জয় করতে পারবেন শুধু নিজের পড়াশোনা, শিক্ষার যোগ্যতা দিয়েই।

জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ওই সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং বিচারে তাঁর তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। সেখানেই তিনি পবিত্র কোরান শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থ পড়া শুরু করেন। তখনই তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন, যে আত্তীকরণ করে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে
যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন।

Rahul-Sangkrityan001

রাহুল সাংকৃত্যায়নের জীবন আদপে ভারতের উত্তরণের যাত্রা, ভারত উত্তরণের সাক্ষী বললেও অত্যুক্তি হয় না। ভারতের নবজাগরণ থেকে শুরু করে স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের জন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত এক যাত্রার ভাষ্য হল তাঁর জীবন। এমন
এক জীবনকথা যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস হয়ে থেকে গিয়েছে। রাহুল তাঁর 'মেরি জীবন যাত্রা' গ্রন্থে এমন এক ভারতবর্ষের কথা লিখে গিয়েছেন, যে ভারতের অস্তিত্ব এক কালে ছিল, কিন্তু এখন অদৃশ্য। রাহুলের লেখা থেকেই সেই ভারতকে
পুনরাবিষ্কার করা সম্ভব।"মেরি জীবন যাত্রা" বইয়ের ভূমিকায় বুদ্ধকে তাঁর শিক্ষক, গুরু আখ্যা দিয়ে তিনি লিখেছেন "নানা অভিমতকে আমি গ্রহণ করেছি একটা নৌকার মতো যাতে নদী পেরিয়ে বিপরীত দিকে যেতে পারি কিন্তু সেই অভিমতগুলোকে
এমন বোঝা করে তুলিনি যাতে মনটাই পাষাণভার হয়ে যায়"।

'মুণ্ডন'-এর সময় সারনাথের ধামেক ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে ট্রেনে চড়ে যাওয়ার স্মৃতি লিখে গিয়েছেন রাহুল। লিখে গিয়েছেন লোরিক নামের আহির-এর কথা, দুই বিশাল ঘড়া ভর্তি দুধ নিয়ে কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে ধামেকের সিঁড়ি বেয়ে নামছিল
সে। সে দিনের শিশু কেদার তিন দশক পরে ফিরে এসেছিলেন একই জায়গায়, বৌদ্ধ পুনরভ্যুদয়ের সমর্থক রাহুল সাংকৃত্যায়ন হিসেবে। মহাবোধি সোসাইটির মূলগন্ধকুটি বিহারের উদ্বোধনে ধর্মপালকে সাহায্য করতে এসেছিলেন তিনি সে বার। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে জানা গেছে, এই জায়গাতেই ছিল অশোকের ধামেকস্তূপ।

তিরিশ বছর ধরে, একটু একটু করে গ্রাম্য কিশোর কেদার হয়ে উঠেছিল রাহুল সাংকৃত্যায়ন নামের এক পরিণত চিন্তক। যিনি একই সঙ্গে কর্মী ও পণ্ডিত। তাঁর পরিবারে এই সারস্বত সাধনার সমর্থন সে ভাবে ছিল না। নিজের পারিবারিক 'সংকৃতি' গোত্র সম্পর্কে রাহুল এক বার মজা করে বলেছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার অভ্যেস শেষ হয়ে গিয়েছিল মধ্যযুগেই, যখন ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে যোগ ছিন্ন করে তাঁরা নিজেদের কতকগুলো গ্রাম্য ও অসংস্কৃত নাম দিয়েছিলেন।

২০ বছর বয়স থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। প্রতিদিনের দিনলিপি রাখতেন সংস্কৃত ভাষায়। পরে তা আত্মজীবনী লিখতে সাহায্য করেছিল। তার মাতৃভাষা ছিল ভোজপুরী,তবে তিনি মূলত সংস্কৃতেই লেখালেখি করতেন। এছাড়াও হিন্দী ব্যবহার করতেন।
তিনি অন্তত ৩৬টি ভাষা জানতেন। ভ্রমণ, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান সব কিছুকেই ছুঁয়েছেন কলমের জোরে। জীবনী ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও আছে। লেখক জীবনের পরের দিকে মৌলিক কাজ অব্যাহত থাকলেও গ্রন্থ
সম্পাদনা, অভিধান সঙ্কলন ইত্যাদি তুলনামুলকাভাবে বেশি করেছেন। এ সময় তিনি সর্বহারা শ্রেণীর মহান নেতাদের জীবনী রচনায় মনোযোগ দেন।

rahul-with-suryakant-tripathi

পড়াশোনার সুযোগ পেলেন বারাণসীতে, আর বিহারের ছাপরার কাছে পারসা মঠে। সংস্কৃত শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে দক্ষিণ ভারতের তিরুমিশির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন, সে যাত্রার অনেকটা অংশই পায়ে হেঁটে। মহাকাব্যিক এই যাত্রায় রাহুল বুঝতে পারলেন, ভারত হল নিরবশেষ এক ভূখণ্ডের নাম, যেখানে প্রতি চার ক্রোশ অন্তর মানুষের মুখের ভাষা বদলে যায়। উত্তর ভারতে অযোধ্যায় তিনি আকৃষ্ট হলেন আর্যসমাজের প্রতি। লাহৌর আর আগরার আর্য মুসাফির বিদ্যালয়ের বৌদ্ধিক ছত্রছায়ায় তিনি যেন পুনরাবিষ্কার করলেন ভারতের বৈদিক অতীতকে। ফিরলেন বৈষ্ণব দর্শনের পথ থেকে। এই সময়েই প্রবেশ করলেন ভারতীয় দর্শনের গভীরে।

তখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে, নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছে। যে বিহারে এক দিন তিনি সন্ন্যাসী রূপে কাজ করেছেন, সেই বিহারেই রাহুল কাজ শুরু করলেন কংগ্রেসের কর্মী-প্রচারক হিসেবে। রাজনৈতিক কার্যকলাপের কারণে কারাবন্দি
হলেন। বন্দিদশায় পড়লেন বৌদ্ধযুগের ভারতে ফা-হিয়েন-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত,বর্মি লিপিতে লেখা পালি গ্রন্থ 'মজ্ঝিমনিকায়'। পরবর্তী কালে ভারতে বৌদ্ধ পুনরুভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে প্রধান কাজ ছিল সংস্কৃত গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি খুঁজে বের করা। এই গ্রন্থগুলি হারিয়ে গিয়েছিল, ভারতে এগুলির কোনও খোঁজই ছিল না। বৌদ্ধশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত রাহুল জানতেন, ভারতের লিখিত ইতিহাসে ১৫০০ বছরের বিচ্যুতি রয়েছে,যখন বিহার ও বাংলা থেকে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল কাবুলে, দক্ষিণ ভারতে। রাহুল চার বার তিব্বত গিয়েছিলেন। দুঃসাহসিক এই চারটি যাত্রায় তিনি ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেকগুলি হারিয়ে যাওয়া পাতা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ব্যক্তিগত জীবনের পুরোটাই কেটেছে ভ্রমণ করে। ভোজপুরী, মৈথিলী, নেপালি, রাজস্থানী প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষায় তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি এমনকি ফটোগ্রাফিও শিখেছিলেন। বারবার বাড়ি থেকে পালিয়েছেন, এই ভ্রমণের নেশাই তার নেপথ্যে। তিনি ভারতের বিভিন্ন
তীর্থক্ষেত্রে ভ্রমণ করেছেন। মাদ্রাজে তামিল ভাষা শিখেছিলেন। এছাড়াও অন্ধ্র প্রদেশ, ব্যাঙ্গালোর, হাম্পি, কর্ণাটক প্রভৃতি স্থানেও ভ্রমণ করেন। ভ্রমণ করেই তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। তিনি এমনকি তিব্বতের নিষিদ্ধ ভূমিতেও গিয়েছিলেন। কাশ্মীর, কার্গিল প্রভৃতি এলাকা দিয়ে পায়ে হেটে তিনি তিব্বতে প্রবেশ করেন। ১৩ শতকে বখতিয়ার খিলজীর নালন্দা ও
বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার পুড়িয়ে ফেলার পর ভারতে সেই অর্থে তেমন সংস্কৃত ভাষার কাজ খুঁজে পাওয়া যায় না। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃত পুঁথি উদ্ধার করা।তিব্বত থেকে তিনি পালি ও সংস্কৃতের মূল্যবান পুঁথি, বই ও কিছু চিত্রকর্ম নিয়ে আসেন। এগুলো নালন্দা ও বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ তিব্বতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিব্বতী ভাষা শিখেছিলেন।তিব্বত-হিন্দী অভিধান রচনা করেছিলেন, যার শুধুমাত্র প্রথম অংশ তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। তিনি এরপর শ্রীলঙ্কা, জাপান, কোরিয়া, চীন, রাশিয়া,তেহরান, বালুচিস্তান প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন।

Rahul-on-tibet

বৌদ্ধ ধর্মস্থানগুলিতে ভ্রমণের ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজ পরিবর্তনের জন্য সক্রিয়তার দরকার। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা তাঁর প্রচারপত্রটি তিনি লিখেছিলেন লাসা-য় বসে। ১৯৩৮ সালে তাঁর শেষ তিব্বত অভিযান
থেকে ফেরার পর বিহারে কৃষকদের হয়ে কাজে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন তিনি। অল ইন্ডিয়া কিসান সভার সভাপতি নির্বাচিত হলেন, ১৯৩৯ সালে ফের কারাবন্দি হলেন।১৯৪৩-এ হাজারিবাগ কারাগারে বসেই কথাসাহিত্যের আদলে লিখেছিলেন 'ভলগা সে
গঙ্গা'। লেখার জন্য বিরোধীতার মুখেও পড়তে হয়েছে, ভলগা সে গঙ্গা রচনার পর ভারতের হিন্দীভাষী প্রায় সমস্ত অঞ্চলে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল রাহুলকে। এই বই লেখার সময় কাজে লাগিয়েছিলেন সেই একই ঐতিহাসিক তথ্য
আর নোট, মানবসভ্যতার বিবর্তন নিয়ে লেখা তাঁর ধ্রুপদী মার্কসীয় গ্রন্থ 'মানব সমাজ' লেখার ক্ষেত্রেও যা ব্যবহার করেছিলেন।

কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষের পরিবর্তনের চেষ্টা করতে চেয়েছিলে। সাংস্কৃতিক ভারতের যে আধুনিক ভারতের নিজস্ব সম্পদ নয়, বরং বহির্ভারতের সভ্যতাগুলিতেও তার বিকাশ হয়েছিল, রাহুলের লেখা এ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে। এক নদীর রূপক
ব্যবহার করেন তিনি, অসংখ্য শাখানদীকে যে নদী নিজেতে মিশিয়ে নিয়ে বয়ে চলে। রাহুল বলেন, মিশ্র সংস্কৃতিগুলি এভাবেই একে অন্যের মধ্যে জড়িয়ে থাকে,তাদের সাক্ষাৎ হয়।

তাঁর ভাবনার ভারতবর্ষ পারস্পরিক সমতা ও সমানাধিকারের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এক রাষ্ট্র। এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে চলতে চলতেও, রাহুল সব সময় যেমন বুদ্ধের, তেমনই বুদ্ধির, মননেরও প্রকৃত অনুগামী।

জীবনের প্রায় শেষলগ্নে, শ্রীলঙ্কার বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ​শ্রীলঙ্কায় তিনি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। পরে তিনি স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬৩ সালের ১৪ই এপ্রিল দার্জিলিং  শহরে রাহুল সাংকৃত্যায়ন মৃত্যুবরণ করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...