বিশ্ব টেলিভিশন দিবস

পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে,
স্যাটেলাইট আর কেবলের হতে,
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী...!
মনে পড়ে মহিমের ঘোড়াগুলির এই কালজয়ী গান। হ্যাঁ, আজ সেই বোকাবাক্সেরই দিন। আজ একবিংশ শতক একটি জিনিসেই আটকে গিয়েছে সব। আমাদের দৈনন্দিন জীবন এখন টেলিভিশনের উপরেই নির্ভরশীল। এহেন জিনিসের একটা দিন থাকবে না? তা কি হয়?
 
 
আজ সেই তাদেরই দিন, আজ বিশ্ব টেলিভিশন দিবস। দিবসের অন্ত নেই, আমরা কত কিছু নিয়েই না দিবস পালন করি। 
টেলিভিশন ইংরেজি শব্দ, গ্রিক ও ল্যাটিন  শব্দ মিলিয়ে যার জন্ম।
 
 
গ্রিক শব্দ টেলি অর্থাৎ দূরত্ব আর ল্যাটিন শব্দ ভিশন-এর অর্থ হল দেখা। এই দুটো মিলে টেলিভিশন। যেখানে আমরা একই সঙ্গে ছবি দেখি এবং শব্দ শুনতে পাই। বাংলা এর নাম দূরদর্শন। আমাদের জীবন এর প্রভাব অপরিসীম। গত এক শতাব্দীর মধ্যেই টেলিভিশন আমাদের পরিবারে সদস্য হয়ে উঠেছে। এমন কি সে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতেও শুরু করে দিয়েছে।
 
 
কেমন করে? ভাবতে অবাক লাগছে? এই ধরুন আগে কটা বাজে জানতে ঘড়ি দেখতে হত। আজ কোন সিরিয়াল চলছে দেখলেই জানা না যায়, ঘড়িতে কটা বাজে। বাড়িতে এসে আপনি চা চাইলেন...আপনার স্ত্রী বললেন, এটা দেখেনি তার পরে পাবে। মানে আপনার চা পানের সময়ও ঠিক করে দিল একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান। তাহলে সে কি আমার আপনার নিয়ন্ত্রক নয়!
কিভাবে এল আজকের দিনটি? 
 
 
 
 
১৯২৬ সালের আজকের এই দিনে, অর্থাৎ ২১ শে নভেম্বর বিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রসংঘ আয়োজিত এক ফোরামে ২১শে নভেম্বর দিনটিকে 'বিশ্ব টেলিভিশন দিবস' হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ২১শে ও ২২শে নভেম্বর রাষ্ট্রসংঘ প্রথম ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন ফোরাম আয়োজন করে। পৃথিবী পরিবর্তনশীল, সদা পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর টেলিভিশনে প্রভাব যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মধ্যে মানবিক সম্পর্কের বিকাশের টেলিভিশন জরুরি ভূমিকা পালন করে।
 
 
এই সব নিয়েই আলোচনা করতে এই ফোরাম আয়োজিত হয়েছিল। আজ একবিংশ শতকে গণযোগাযোগ ও বিশ্বায়ণের প্রতীক হয়ে উঠেছে দূরদর্শন। টেলিভিশনের জনমানসে যেমন প্রভাব আছে, তেমনই আর্থিক ও সামাজিক নানান ক্ষেত্রও আজ এর দ্বারা প্রভাবিত। মানব জীবন ও সভ্যতায় টেলিভিশনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে স্বীকৃত দিতেই আজকের এই দিনের উদযাপন।
 
 
১৯৯৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘ রেজলিউশান পাশ করে এই দিনটি পালন করতে শুরু করে। তারপর থেকে আজ অবধি প্রতি বছর ২১শে নভেম্বর দিনটি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন ডে হিসেবে পালিত হচ্ছে। 
 
 
এই টেলিভিশনই হল বিংশ শতকের অন্যতম বড় আবিষ্কার। যার দাপট একবিংশ শতকেও অব্যাহত। সারা বিশ্বের মতো ভারতেও এর দাপট রয়েছে। ১৯৪০ সাল থেকে টেলিভিশন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টেলিভিশনের আমূল পরিবর্তন আসে, রীতি মতো বিপ্লব ঘটে যায়। বিগত শতকের পাঁচেত দশকে টেলিভিশন গণমাধ্যমের ভূমিকায় উঠে আসে। জনমত গঠনে গুরত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। নিছক বিনোদনের মাধ্যম ছেড়ে বেরিয়ে টেলিভিশন আজ মানুষের আওয়াজ হয়ে উঠেছে।
 
 
TelevisionDay1
 
 
এই পঞ্চাশের দশকেই চেন্নাইয়ে এক ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র এদেশের প্রথম টেলিভিশন সেট তৈরি করেন। যা বানানো হয়েছিল একটি প্রদর্শনীর জন্যে। ১৯৫৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর রাজধানী দিল্লিতে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রথম পরীক্ষামূলক সম্প্রচার হয়। ১৯৬৫ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর একটি অংশ হিসেবে দিল্লিতে দৈনিক সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৭২ সালে রাজধানীর বাইরে মুম্বই ও পাঞ্জাবের অমৃতসরে এই পরিষেবা শুরু হয়। ওই সময় সকাল বিকেল মিলিয়ে, দিনে মাত্র দুবার দুটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার হত। ১৯৮২ সালে সারা দেশ জুড়ে জাতীয় টেলিভিশনের সম্প্রচার শুরু হয়। ওই বছরই প্রথম ভারতের বাজারে আসে রঙিন টেলিভিশন সেট। তখন টেলিভিশন চ্যানেল বলতে দূরদর্শন। যা ছিল সরাসরি কেন্দ্র সরকারের অধীনে।এদেশে টেলিভিশনের দুনিয়ায় বিপ্লব আসে নয়ের দশকে, তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের নতুন নীতির হাত ধরে এদেশে ব্যবসা করার অনুমতি পায় বেসরকারী চ্যানেলগুলি। 
 
 
এর আগে আশির দশক থেকেই টেলিভিশনে নতুন এক জিনিসের আবির্ভাব ঘটে যায়। টেলি-ধারাবাহিকের সূচনা হয়। যা এককালে ডেলি সোপ নামে পরিচিত ছিল। রামায়ণ, মহাভারত  ধারাবাহিকের জগতে কালোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। আজও তাঁদের রেকর্ড অক্ষত। হাল আমলে এই করোনা সংক্রমণের কারণে টেলিভিশন চ্যানেলের শ্যুটিং বিঘ্নিত হলে, চ্যানেলগুলি এই সব পুরনো অনুষ্ঠানগুলিই পুন:সম্প্রচার করে। কথায় বলে না পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। তেমনই হয়েছিল। টেলিভিশনের ছোটপর্দাই এখন আমাদের বিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম। ঘরবন্দী লকডাউন টেলিভিশনই আমাদের সঙ্গ দিয়েছে। 
 
 
রাষ্ট্রসংঘ প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সারা পৃথিবীতে টেলিভিশন রয়েছে এমন পরিবারের সংখ্যা ছিল ১.৬৩ মিলিয়ন। যা ২০২৩ সাল নাগাদ ১.৭৪ বিলিয়নে পৌঁছবে। এদেশে এই মুহূর্তে প্রায় ২৯৮ মিলিয়ন পরিবার টেলিভিশন মাধ্যমের দর্শক। তার মধ্যে ১৯৭ মিলিয়ন পরিবারের নিজস্ব টেলিভিশন রয়েছে। আগামী কয়েক বছরে যা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
 
 
উৎসব থেকে ছুটির দিন, যৌথ পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, এক সঙ্গে জমিয়ে বসে টেলিভিশন দেখার মজাই আলাদা। খাবার টেবিলে নৈশভোজ সারতে সারতে, আলসে অবসর যাপনে টেলিভিশনের জবাব নেই।
 
 
ছায়াছবি থেকে ধারাবাহিক, রিয়েলিটি শো থেকে টেলিফিল্ম এই সব কিছু নিয়েই টেলিভিশন আমাদের মনোরঞ্জন করে চলেছে। মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার সব কিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়েও আজ টেলিভিশন অপরিহার্য, অক্ষত, অজেয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...