‘এঁর নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ইনিই আমার পরের ছবি ‘অপুর সংসার’-এর অপু’

বেলেঘাটার একটা ছোট ওষুধের কারখানা। সেখানে কাজ খুঁজতে এসেছে এক তরুণ। লেবেলিং আর বটলিং-এর কাজটা ঠিক কেমন করে হয়, দেখতে কারখানার ভিতরে ঢুকেছে সে।

ছোট্ট একটা কামরা। তার মধ্যে ক্লান্ত কিছু মুখ। যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে তারা। লেবেলিং আর বটলিং। তাদের দেখেই হাঁফিয়ে ওঠে তরুণ। বুঝে যায় এ কাজ তার দ্বারা হবে না।

sharmila-tagore-soumitra-chatterjee_11zon

প্রথম শটেই শট ‘ওকে’। এই ছিল তাঁর প্রথম দিনের শুটিং। জীবনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্যামেরার সামনে আসা। তার আগে অবশ্য এসেছিলেন। এই চরিত্রের জন্য চূড়ান্ত পর্বের নির্বাচনের সময় ক্যামেরা টেস্ট নিয়েছিলেন ছবির পরিচালকমশাই। সেই কারণে ক্যামেরার নিয়ে বেশী সচেতন থাকার প্রবণতাটা হালকা হয়ে গিয়েছিল।

পরিচালক মশাই কিন্তু বেশ খুঁতখুঁতে। ইতিমধ্যেই প্রথম ছবি দিয়ে বিশ্বজয় করে ফেলেছিলেন তিনি। নবাগত অভিনেতাটিও তাঁর মুগ্ধ দর্শক!

পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায় আর নবাগত অভিনেতাটির নাম সৌমিত্র। পুরো নামে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালির অপু।

কীভাবে অপুর ভূমিকায় এলেন তিনি?

সেদিনের স্মৃতি শোনা যাক তাঁর মুখেই। স্মৃতিকথায় লিখছেন, “…একদিন বিকেলে কফিহাউস যাচ্ছি, তখন আমি মির্জাপুর স্ট্রিটে থাকি, আমার এক বন্ধু আমাকে রাস্তার ওপার থেকে ডাকল।…আমি একটু অবাক, কারণ আমি তো আমাদের যৌথ গন্তব্যস্থলের দিকেই যাচ্ছি…”

E49AGvFUYAAhUy9_11zon

রাস্তা পেরিয়ে বন্ধু অরুণের কাছে গিয়ে দেখলেন, সে যেন ফুটপাতের ওপারে কার সঙ্গে চোখের ইশারায় কথা বলছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হল? কার সঙ্গে কথা বলছিস?”

তখন সেই বন্ধু বললেন, “তাহলে তোকে সব খুলেই বলি। ‘পথের পাঁচালি’র পর সত্যজিৎ রায় ‘অপ্রাজিত করবেন, ‘অপু’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য একজন নতুন অভিনেতা খুঁজছেন, আমি তোর কথা বলেছি।”

বন্ধুর মুখে আরও জানতে পারলেন ফুটপাতের ওপারে থাকা মানুষটি সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটের নিত্যানন্দ দত্ত। তাঁর কি কোনও আপত্তি আছে?

সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, ‘ওঁর ছবি হলে আমার কোনও আপত্তি নেই’।

 অরুণের ডাকে এপারে এলেন নিত্যানন্দ দত্ত। তিনি আগেভাগেই জানিয়ে দিলেন, ‘যদি সত্যজিৎ বাবাউর পছন্দ না হয়…’

সৌমিত্র তখনই জানিয়ে দিলেন, ‘না তাতে কোনও অসুবিধা নেই, যদি পছন্দ হয়, তাহলে তো দারুণ ব্যাপার!’

যাওয়ার কথা ছিল কলেজ স্ট্রীট, কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হল না। কারণ তখন বাস ধরতে হল। সঙ্গে সদ্য আলাপ হওয়া নিতাইবাবু। পরে জানতে পারবেন এই নিতাইবাবুই আসলে সত্যজিৎ রায়ের সহকারী পরিচালক। কেন যে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সহকারী পরিচালক সে কথা সৌমিত্র মনেপ্রাণে অনুভব করতে পেরেছিলেন বাসযাত্রায়।

 তখন চশমা পরতেন সৌমিত্র। ভিড়ে বাসে যেতে যেতে নিত্যানন্দ ওরফে নিতাইবাবু বললেন, ‘আপনার চোখের চশমাটা খুলে ফেলুন তো!’

17soumitra3_11zon

চশমাটা খুলে পকেটে ভরে নিলেন তখনই। বাসের ভিড়ের মধ্যে গোটা রাস্তায় তাঁকে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলেন সত্যজিতের সহকারী।

তাঁরা পৌঁছলেন লেক অ্যাভিনিউতে। সেখানেই তখন থাকতেন সত্যজিৎ। নবাগত যুবকটি ঘরে পা রাখা মাত্রই তাকে দেখে পথের পাঁচালির পরিচালক বলে উঠলেন, ‘এ হেঃ আপনি যে বড্ড লম্বা হয়ে গেলেন!’

অপরিচিত আগন্তুককে কথাটা বলেই যেন নিজেকে সামলে নিলেন। সৌমিত্রের মনে হয়েছিল একজন মানুষ একমনে কতটা নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে এভাবে কথা বলতে পারেন! যেন সারাক্ষণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর অপুকে।

সেদিন অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল দুজনের। গমগমে গলা, বিরাট চেহারা, এমন গুণী মানুষ, আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন অথচ কত সহজ সাবলীল। ব্যাপারটা টেনেছিল তাঁকে।

অনেক কথার মধ্যে দুটি প্রশ্ন তিনি করেছিলেন তাঁকে, ‘তিনি সত্যিই অভিনয় ভালবাসেন কিনা, এবং প্রয়োজনবোধে তিনি তিনি সিনেমায় অভিনয় করবেন কিনা’।

ফিরে এসেছিলেন সৌমিত্র। যোগাযোগ রাখতে বলেছিলেন সত্যজিৎ। বেশ অনেকদিন কোনও যোগাযোগ নেই। তবে কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে।

এর মধ্যেই মুক্তি পেল ‘অপরাজিত’। সেখানে অপু চরিত্রে স্মরণ ঘোষাল। আবার আলোড়ন শহর জুড়ে। সৌমিত্র নিজেও সেই ছবির মোহে পড়েছেন। মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সত্যজিতের ফ্রেম। কাশীর গলি, গঙ্গার ঘাট হরিহরের মৃত্যু এমন কত কী!

দিন কেটে যায় কফিহাউস, আড্ডা,কবিতা, নাটকে। কফি হাউসে তাঁদের সেই আড্ডায় আসতেন সত্যজিতে আর এক সহযোগী সুবীর হাজরা। মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘তোমাকে কিন্তু ওঁর মনে আছে, তোমাকে কিন্তু উনি ডাকবেন…’। তবে সৌমিত্র এসব নিয়ে খুব ভাবেন না। অত বড় মানুষের ডাক পাওয়া কী সহজ! খানিক লজ্জা, খানিক সংশয় আর যেন খানিক অবিশ্বাস!

তার মধ্যেই চাকরি পেলেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে। গাস্টির্ন প্লেসে অফিস। সালটা ১৯৫৭ নাগাদ। চিকেন পক্স হল। বেশ কিছুদিনের জন্য বিছানাবন্দী। সুস্থ হলেও পক্সের দাগ তখনও ঝাপসা হয়নি। হঠাৎ একদিন বাড়িতে এলেন সুবীর হাজরা। ডেকে পাঠিয়েছেন সত্যজিৎ!

সঙ্গে সঙ্গেই গেলেন না সৌমিত্র। বেশ কয়েকটা দিন পর গেলেন।

ঘরে ঢুকতেই সত্যজিৎ বলে উঠলেন, ‘আরে আসুন!এতো দেখছি ঠিকই আছে, মুখে তো বিশেষ দাগ হয়নি!কে যেন বলছিল মুখে অনেক দাগ হয়ে গেছে!’

সেদিন সত্যজিৎ জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁকে- অভিনয়ে আগ্রহ আগের মতোই আছে তো?

মাথাটা নিচু করে সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই…’

তখনও আনকোরা শিশির কুমার ভাদুড়ীর ছাত্রটি সেদিন লেক অ্যাভিনিউ রোডের সেই বাড়ির লম্বা মানুষটিকে সঙ্কোচ আর লজ্জায় বলতে পারেননি মনে মনে কেমন অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলেন ওঁর একটি ডাকের জন্য।

সত্যজিৎ তাঁকে বলেছিলেন একটি স্ক্রিনটেস্ট হবে তাঁর। ‘পরশপাথর’ আর ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেটে যেতেন সৌমিত্র। ধীরে ধীরে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল কেমন করে কাজ করেন সত্যজিৎ। সত্যজিৎ নিজের দুনিয়ার সব দরজা হাট করে খুলে দিয়েছিলেন তাঁর ইস্কুলের এই ছাত্রটির জন্য। যেন পরীক্ষায় বসানোর আগে ভাল করে তৈরী করে দেওয়া।

 তাঁর দুনিয়ায় যাই দেখতেন গোগ্রাসে গিলতেন, ছানতেন সৌমিত্র।  তবে এই লেনদেন কিন্তু এক তরফা হচ্ছিল না। সত্যজিৎও জানতে লাগলেন কী করেন সৌমিত্র, কী পড়েন, কী শোনেন, তাঁর পড়াশোনা, চর্চা, গুরুসঙ্গের কথা। সেই গুরুর নাম শিশিরকুমার ভাদুড়ী।

DDUaijbVwAAiaFr_11zon

এসব চলতে লাগল। তখনও কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জানেন না সত্যজিতের কোনও ছবিতে তিনি আদৌ আছেন কিনা, বা থাকলেও কোন চরিত্রে। তিনি যে খুব জানার চেষ্টা করছিলেন এমনও নয়। পথের পাঁচালির পরিচালক তাঁর কাছে ‘মানিক বাবু’। যদিও আড়ষ্টতা কেটে গিয়ে বেশ ঘনিষ্ঠতা এসেছে বলাই যায়। সালটা সাতান্নই।

একদিন একটা কান্ড হল। সে কান্ড ঘটালেন সত্যজিৎ নিজেই। ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং চলছে। সারাদিন শুটিং দেখা কাজ। বিকেল বেলায় রেডিয়োর অফিস। সেদিন শুটিং থেকে অফিস যাবেন সৌমিত্র। বেরবে বেরবে করছেন। সত্যজিতের কাছে এলেন। বিদায় জানিয়ে অফিস যাবেন।

হঠাৎ সত্যজিৎ বললেন- ‘আসুন আপনার সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের আলাপ করিয়ে দিই, আলাপ নেই তো?’

ঘাড় নাড়লেন সৌমিত্র। মনে মনে ভীষণ খুশি, ভীষণ অবাক!

ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে গেলেন তিনি। সেই বিখ্যাত ব্যারিটোন ভয়েসে ছবি বিশ্বাসকে বললেন, ‘ছবিদা! এঁর নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ইনিই আমার পরের ছবি ‘অপুর সংসার’-এর অপু।’

সেই মুহূর্ত থেকেই যেন জন্ম হয়েছিল এক নতুন ইতিহাসের। শুধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নয়, ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রেই যা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

অপু আর অপু চরিত্রের অভিনেতা দু’জনকেই পিতৃস্নেহে গড়েছিলেন সত্যজিৎ। সৌমিত্র যখন অপুর চরিত্র করতে গেলেন চরিত্রের সঙ্গে তাঁর মনের তেমন দূরত্ব ছিল না। ছবির সময়কাল ১৯৫৮। তখনও যুদ্ধ, রাজনৈতিক টানাপোড়ন, অবিশ্বাস, হতাশা, মানবক্ষয়, মৃত্যু গ্রাস করেনি। রোম্যান্টিকতার মায়াকাজল হালকা হলেও লেগে আছে সমাজের চোখে। তাই আনমনা, বিবাগী মনের বাউন্ডুলে অপুকে মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি। তাই তার ছাদের ঘরের তেলকালি আর উনুনের ধোঁয়ায় চোখে ঝাঁঝ লাগলেও বাঁশি উঠে আসে হাতে। বাঁচতে চায় সেই আবহেই।

অপু পুরনো হয়েছে। বৃদ্ধ হয়েছেন অপুর অভিনেতাও। কিন্তু সময় কাড়তে পারেনি অপুর লাবণ্য। অপু তাই বাঙালির কাছে অবিনশ্বর। অপুর পৃথিবীটা এখনও খুঁজে চলেছে এই পৃথিবী।

“শিক্ষার ভিতর দিয়ে, স্ট্রাগলের ভিতর দিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি তার গোঁড়ামি, কুসংস্কার,সমস্ত কেটে যাচ্ছে, বুদ্ধি দিয়ে ছাড়া কোনও কিছু সে মানতে চাইছে না। কিন্তু তার কল্পনাশক্তি আছে। তার অনুভূতি আছে। ছোটখাটো জিনিস তাকে মুভ করছে। তাকে আনন্দ দিচ্ছে। হয়ত তার ভিতরে মহৎ একটা কিছু করার ক্ষমতা আছে। সম্ভাবনা আছে। কিন্তু করছে না...কিন্তু সেইটাই শেষ কথা নয়...সেইটাই ট্র্যাজেডিও নয়। সে মহৎ কিছু করছে না। তার দারিদ্র্য যাচ্ছে না। অভাব যাচ্ছে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না। সে পালাচ্ছে না। এসকেপ করছে না। সে বাঁচতে চাইছে। সে বলছে বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা...”  

তথ্যসূত্র- মানিকদার সঙ্গেঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

চরিত্রের সন্ধানেঃ  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

 

   

   

 

    

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...