প্রকৃত অর্থেই তিনি অপরাজিতা। তিনি হার মানতে শেখেননি। কম বয়সে বেহালায় বিয়ে হয়ে আসেন অপরাজিতা। অপরিচিতা গাঙ্গুলী নিজে উত্তর কলকাতার মেয়ে। বিবাহিত জীবনে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য না থাকলেও, তেমন দৃঢ় বন্ধনও ছিল না। শ্বশুরবাড়ির বাকি সদস্যরাও সুনজরে কখনই দেখেননি অপরাজিতাকে। দুই সন্তান আসে। তাদের নিয়ে কোনমতে কেটে যাচ্ছিল অপরাজিতার জীবন।
তার মাঝেই আসে বিপর্যয়। একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কিছু অপরিচিত দুষ্কৃতিদের হাতে খুন হন অপরাজিতার স্বামী। অন্ধকারগুলো সাপের মতোই অপরাজিতার জীবনকে পেঁচিয়ে ধরে এবার।
শ্বশুর, শাশুড়ি দেওর পুলিশের কাছে অভিযোগ করে অপরাজিতাই নাকি ষড়যন্ত্র করে স্বামীকে খুন করিয়েছেন। আর কোন এক আশ্চর্য জাদুবলে অপরাজিতার শ্বশুরবাড়ির পরিবারের কথাই বিশ্বাস করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় সদ্য স্বামীহারা অপরাজিতাকে।
এক বন্ধুর সঙ্গে অপরাজিতার স্বামীর বিরোধ ছিল। পুলিশের তরফে ধরে নেওয়া হয় সেই বন্ধুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেই অপরাজিতা হত্যা করেছেন স্বামীকে। মামলা চলতে থাকে দিনের পর দিন। কিছুতেই মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যে অপরাধ স্বীকার করেন না অপরাজিতা। দিনের পর দিন গরাদের আঁধারে কাটতে থাকে জীবন। কাঁকুরে ভাত, জলের মতো ডাল, পোড়া রুটি খেয়েও আসল ঘটনা সামনে আনার লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন অপরাজিতা।
অপরাজিতার উল্টোদিকের লড়াইটাও কম ধারালো ছিল না। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও অপরাজিতার বিরুদ্ধে কোন স্থায়ী প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। তেরো বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পান অপরাজিতা। অপরাজিতার হয়ে কেস লড়ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়।
কারাকক্ষের অন্ধকার অপরাজিতাকে শিখিয়েছিল আলোয় ফেরার হন্যে লড়াই। জয়ন্তবাবুর সঙ্গে এই মামলার সূত্রে আলাপ হয়ে অপরাজিতা জানতে পারেন এমন অজস্র নির্দোষ মহিলা জেলে এভাবেই বন্দী থাকে দিনের পর দিন।
অপরাজিতা যেখানে জেলে বন্দি ছিলেন সেই সংশোধনাগারেও বেশ কিছু এমন নির্দোষ মেয়ের সঙ্গে অপরাজিতার আলাপ হয়। যে আঁধার পেরিয়ে এসেছেন সেই আঁধার আরও গাঢ় হয় ঘরে ফিরে। আবার আঘাত। আবারও অন্ধকার। এবারের এ আঁধার নির্মম দুনিয়ার রুক্ষ উপহার।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমেই অপরাজিতা ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের কাছে। ১৩ বছর মা-হারা যে তারা! কিন্তু সন্তানরা বদলে গিয়েছে। তারা আর ছোট্টটি নেই কেউ। জেলফেরত অপরাজিতা গাঙ্গুলীকে ‘মা’ বলে চিনতে অস্বীকার করল তারা। প্রথম দিকে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সখাদ অন্ধকারের সামনে আলো-রোদ-মাটি-আসমানের মুক্ত যে জীবন, তার ডাকও, যে উপেক্ষার নয়। ফিরে তাকালেন জীবনের দিকে।
অপরাজিতার মনে হয় তার মতো এমন বহু মেয়ে এভাবেই নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও জেলে বন্দি। জেল থেকে ছাড়া পেলেও সমাজ তাদের মেনে নেবে কিনা সে নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। মানে ইতিবাচক জীবনের পথে তারা এগোতে চাইলেও যে সব হারাবে, এমনটা যেন নিশ্চিত করেই দেওয়া হয়েছে।
এবার অপরাজিতা সেই সব মেয়েদের জন্য লড়াই করতে শুরু করলেন আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তারা দুজনে মিলে এমন বহু মামলার সাক্ষী থেকেছেন যেখানে নির্দোষ মেয়েরা বহু বছর পর ছাড়া পেয়েছেন জেল থেকে।
এইসব মেয়েদের সঙ্গী করে অপরাজিতা একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন। ‘অ্যাসিড ভিক্টিম’দের নিয়ে মূলত তারা কাজ করতে শুরু করেন। অ্যাসিড আক্রান্ত যেসব মেয়েরা বাঁচার জন্য একটু অবলম্বন খুঁজতে ব্যস্ত তাদের আশ্রয় হয়ে ওঠেন অপরাজিতা এবং তাঁর মহিলা সঙ্গীরা। এখনও তাঁরা যে কোন ধরনের অত্যাচারিতা মেয়েদের জন্য কাজ করেন। তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। শুধু তাই নয়, সেই সব অত্যাচারিতার মেয়েরা অপরাজিতার সঙ্গে যোগদান করে নিজেরা আলো দেখে এবং অন্যদের আলো দেখায়। তাই অপরাজিতা প্রকৃত অর্থেই অপরাজিতা হয়ে আরো অজস্র মেয়েকে জিতিয়ে দিয়ে চলেছেন।