রাজস্থানের যোধপুর। নারী-বিদ্বেষ, পুরুষতান্ত্রিকতা আর জাতপাতের কেন্দ্র যেন। একথা বলাই যায়, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নেই এমন জায়গা ভারতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দাহাড় ওয়েব সিরিজ অত্যন্ত যত্ন সহকারে বৈষম্য দ্বিধা দ্বন্দ্বের নিখুঁত দৃশ্যায়ন ঘটিয়েছে যোধপুরের প্রেক্ষাপটে। দাহাড় তা সপাটে সমাজকে দেখায়। পক্ষপাতদুষ্ট সমাজের নিখুঁত চিত্রায়ন। এই পক্ষপাতদুষ্টতা আসলে পুরুষতন্ত্রের প্রতিফলন।
একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহা অর্থাৎ পুলিশ ইন্সপেক্টর অঞ্জলি ভাটিকে তার মা যখন বিয়ের জন্য পাত্র পছন্দ করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো ছবি দেখাচ্ছে সোনাক্ষী তখন বালিশের নিচে থেকে অনেকগুলো মেয়ের ছবি বের করে মায়ের সামনে ছড়িয়ে দেয়। সে বলে "এই ২৯ জন মেয়ে মারা গেছে কারণ তাদের মায়েরা সারাক্ষণ বিয়ে নিয়ে তাদের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করত। এরা নিচু জাতের মেয়ে এবং আর্থিক দিক থেকে তেমন সবল নয়। পরিবারের সারাক্ষণ বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া মেয়েগুলোর মনের মধ্যে এই ভাবনা তৈরি করে দেয় যে বিয়ে না হলে জীবন বৃথা। তাই এক জঘন্য অপরাধী যে প্রেমিক সেজে তাদের বিয়ে নামের স্বপ্নটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় সেই মেয়েগুলো একবারও সেই অপরাধীকে বিশ্বাস করার আগে দু’বার ভাবেনি। তার কারণ তারা ভেবেছিল বিয়ের মাধ্যমেই একমাত্র জীবনের গতি আসে। বলা ভালো সদগতি। তাই যে ছেলে সামান্য ভালোবাসার আশা জাগিয়েছে তাদের মনে তারা দৌড়ে গেছে তার প্রতি। আর এক সাইকোপ্যাথ অপরাধী সেই সুযোগ নিয়ে ২৯ জন মেয়েকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। সেই সহজ, সরল মেয়েগুলো বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানটাকে এতটাই বিশ্বাস করেছে যে ছেলেটার দেওয়া সায়ানাইড মেশানো গর্ভনিরোধক ওষুধ নির্দ্বিধায় খেয়েছে, কোন সন্দেহ ছাড়াই।"
দাহাড় যেন সমাজের নিখুঁত চিত্রায়ন। নারীবিদ্বেষ কীভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ে তা দেখিয়েছে এই ওয়েব সিরিজ। এই ওয়েব সিরিজে মূল অপরাধী বিজয় বর্মা তার বাবাকেই অনুসরণ করেছে, যে বাবা অপরাধী ছেলেকে ঘৃণা করে অথচ নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেছিল বিদ্বেষ থেকে। ছেলেও তাই মুখের উপর বাবাকে ‘দানব’ আখ্যা দিয়ে নিজেকে সেই দানবের সন্তান বলে দাবি করেছে। ঘৃণার বীজ চারাগাছ থেকে মহীরুহে রূপান্তরিত হওয়ার পথ যে বৈষম্যই দেখায় তা এই ওয়েব সিরিজ সপাটে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের। এই বাবা শুধু যে নারী বিদ্বেষী তা নয় নিজের সন্তানদের মধ্যেও তিনি পক্ষপাত করেছেন। নিজের বড় ছেলেকে সবসময়ই বেশি ভালোবেসেছেন। বৈষম্যের প্রকাশ ঘটেছে এভাবেও।
রাজস্থানের যোধপুরের মাটিতে জাতিভেদ রুক্ষ, কঠিন কাঁটার মত করে প্রকাশিত হয়েছে এই ওয়েব সিরিজের প্রতিটা পর্ব জুড়ে। এই ওয়েব সিরিজের মূল অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহা একজন পুলিশ-ইন্সপেক্টর। সে নীচু জাতের। তার মা সব সময় তার বিয়ে নিয়ে চিন্তিত থাকে। একজন ইন্সপেক্টর হয়েও সোনাক্ষী জাতিভেদপ্রথার শিকার হয়। কটুক্তি সহ্য করতে হয় তাকে। তবে সে এতে দমে যায় না। এবং একদম শেষে সে নিজের পুরনো পদবী অর্থাৎ যে পদবীর মাধ্যমে তাকে নিচু জাতের বলে চিহ্নিত করা হতো একসময় সেই পদবী গ্রহণ করে। অর্থাৎ নিজের সত্তার প্রকাশের দিকেই সে এগিয়ে যায়।
এই ওয়েব সিরিজের পুরুষ চরিত্ররাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বৈপরীত্যের মিশ্রণ সেখানে। ইন্সপেক্টর সোহম শাহ তার বিবাহিত জীবন এবং সেখান থেকে সন্তান আসা নিয়ে দ্বন্দ্বে ভোগে। বিদ্বেষে ভরা কঠিন সমাজে সে সন্তান আসতে দিতে চায় না। তাই এই ক্ষেত্রে সে মনোকষ্টে ভোগে। বিয়ে করার অর্থই সন্তান জন্ম দেওয়া এমন প্রজননবাদতত্ত্বকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সোহম শাহ-এর চরিত্র। তবে পরবর্তীতে তার কনভার্সন সেই আশার কথাই বলে, অর্থাৎ জীবনে আসা মুহূর্তকে মেনে নেওয়া। তবে এই চরিত্রের দ্বন্দ্বের প্রকাশ যথাযথ।
এছাড়াও আরেক পুলিশ ইন্সপেক্টর মার্জিত এবং দ্বন্দ্বে ভোগা এক পুরুষ। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার ব্যতিক্রম তো বটেই। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সময় যখন সে অন্য মেয়েকে কল্পনা করে সে নিজে অনুতপ্ত হয়। দ্বিধাগ্রস্ত হয়। আবার এই পুলিশ ইন্সপেক্টর নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মেয়েকে এগিয়ে দেয় তার স্বপ্নের দিকে।
সমাজের সমস্ত দিকের অপূর্ব চিত্রায়ন এই ওয়েব সিরিজের সমস্ত পর্ব জুড়ে। সমাজের বৈষম্য, সম্পর্ক, অনুভূতি আবার অনুভূতির গণ্ডির বাইরে থাকা মানুষগুলোকেও সপাটে নিজের কথা প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে এই ওয়েব সিরিজ। সিরিজ় পরিচালনায় ‘তলাশ’ খ্যাত পরিচালক রীমা কাগতী ও রুচিকা ওবেরয়। প্রযোজনার দায়িত্বে জ়োয়া আখতার ও রীতেশ সিধওয়ানি। সব মিলিয়ে এই ওয়েব সিরিজ আসলে হয়তো এটি অপরাধের চিত্রায়ন কিন্তু এর শেকড় অন্য জায়গায়। ৮ টি পর্বের এই ওয়েব সিরিজ ‘হু ডান ইট‘ এটা বললেও সজোরে আর অকপটে এই ওয়েব সিরিজ যা বলে তা হলো ‘হোয়াই ডান ইট’।