'স্ত্রী বুদ্ধি' এই শব্দবন্ধটি আক্ষরিক অর্থে মহিলাদের বুদ্ধিকে ক্ষুদ্র করে দেখানোর উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়। কোনো রন্ধনপটীয়সী মহিলা যদি জিহ্বাকে সুখী করতে নুন-তেলের পরিমাণ মত ব্যবহারের ধাঁচে সহজ কায়দায় শত্রুকে কুপোকাত করে, তবে সেই স্ত্রীর বুদ্ধি কিন্তু মোটেই ক্ষুদ্র নয়। আর সেই বুদ্ধি যখন সাহিত্যে কৃষ্টির নিদর্শন হয়ে ওঠে, ফলে যে সাহিত্য জন্ম নেয় তা যেন মায়ের খোলা আঁচলের মতো স্নিগ্ধ। ভাঁড়ার ঘরের মতো গভীর ও গোপন। আর সেই ভাঁড়ার ঘরে লুকিয়ে থাকে মশলাদার রহস্যেরা। আর এইসব ঝাঁপি ভর্তি রহস্যের সমাধান করেছে প্রজ্ঞা পারমিতা মুখার্জী ওরফে মিতিনমাসি। সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দার উদাহরণ দুঃখজনকভাবে কম। আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পল বাদে পাশ্চাত্য সাহিত্যেও মহিলা গোয়েন্দার উল্লেখ সেভাবে মেলে না। আর বাংলা সাহিত্যে সুচিত্রা ভট্টাচার্য সৃষ্টি মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র মিতিনমাসি না থাকলে তারা-খচিত পুরুষ গোয়েন্দাদের বুদ্ধির ছটায় হয়তো হারিয়ে যেত মহিলাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরার ক্ষমতা আর তাদের অনুসন্ধিৎসার প্রশংসা।
মিতিনমাসি কিন্তু বীরাঙ্গনা ব্যতিক্রমী কোন মহিলা নন। রীতিমতো সংসারী। স্বামী পার্থ ও পুত্র বুমবুম কে নিয়ে সংসার নামক বিষমবস্তুকে আগলে রাখেন। তুখোড় বুদ্ধির অধিকারিণী স্মার্ট,ঝকঝকে এই মহিলা প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তার চরিত্রটি বর্তমানে স্বামী-সংসার কাজ দশ হাতে সামলানো দশভুজাদের দক্ষতারই প্রতীক। সংসার আর পেশার মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখায় পারদর্শী। প্রজ্ঞা পারমিতা মুখার্জী তাঁর বোনঝি ও সহকারি টুপুরকে সঙ্গে নিয়ে সমাধান করেছেন নানা জটিল রহস্যের। কলকাতার ঢাকুরিয়া নিবাসী মধ্যতিরিশের এই মহিলা রীতিমতো ভয়েষ সঞ্চার করেছেন শত্রুদের মনে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। তাঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির নাম থার্ড আই। স্বামী পার্থ একটি প্রিন্টিং প্রেসএর মালিক। অনেক রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে এই নিপাট ভদ্রলোকটি সঙ্গ দিয়েছেন মিতিনমাসির। প্রজ্ঞা পারমিতা মুখার্জী থেকে মিতিনমাসি হয়ে ওঠার রাস্তা অনেকটাই মসৃণ করেছে ঐন্দ্রিলা ওরফে টুপুর। টুপুরের মিতিনমাসি যেন আমাদের সেই কাছের মানুষ যাঁর কাছে উজাড় করে দেওয়া যায় মনের সব না বলা কথা। একেবারে আমাদের আপনজন। মিতিনমাসির গল্পগুলোতে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া রয়েছে। যা নিঃসন্দেহে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয়। লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যকে এই মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন আগাথা ক্রিস্টি-সৃষ্ট মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র মিস মার্পল। লেখিকার ভাষায় "তবে কি লেখক এবং পাঠক-পাঠিকারা নিজেদের অজান্তেই ধরে নিয়েছেন গোয়েন্দা হওয়ার মত বুদ্ধিশুদ্ধি মেয়েদের নেই? ক্রিমিনালদের কব্জা করতে গোয়েন্দাকে নানা রকম বিপদ আপদে পড়তে হয়। মেয়েরা কি ওই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার যোগ্য নন? বুদ্ধিদীপ্ত ম্যাচে ইমেজ কি ছেলেদেরই একচেটিয়া সম্পত্তি? এই মধ্যযুগীয় ধারণা হঠাতেই আমার গোয়েন্দা প্রজ্ঞাপারমিতা তথা মিতিনের আবির্ভাব"। আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়নি মিতিনমাসির গল্প। ২০১৪ সালে প্রথম প্রচ্ছদ সমেত বই হয়ে আসে এই কাহিনীগুলো।
মিতিনমাসি কিশোর-কিশোরীদের সাহিত্য। তবে নিজ গুনে এই মহিলা গোয়েন্দা জায়গা করে নিয়েছেন সকল পাঠক মনে। সিনেমার পর্দায় সবেমাত্র আনাগোনা শুরু হয়েছে মিতিনমাসির অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের হাত ধরে। তবে মিতিন মাসি সমগ্রের পাঁচটি গল্প নাবালকত্বের গণ্ডি পেরিয়ে বেশ খানিকটা সাবালকত্বের আঙিনা স্পর্শ করেছে। এই গল্পগুলি হল 'বিষ', 'তৃষা মারা গেছে' ,'মারণ বাতাস' ,'মেঘের পরে মেঘ' ও 'পালাবার পথ নেই'। হি-ম্যান, সুপার-ম্যানদের ভিড়ে মিতিনমাসি যে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে তাঁর উপস্থিতি জানান দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।