প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসের পুরীর বিশেষ আকর্ষণ জগন্নাথদেবের বিখ্যাত রথযাত্রা। যা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম। বহুড়া যাত্রা বা এই রথযাত্রার জন্য যে তিনটি রথ তৈরী হয় তার একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। এই রথ প্রতিবছর নতুন করে প্রস্তুত করা হয় এবং পুরী মন্দিরেরও একটি তাৎপর্য হল বংশ পরম্পরা, অর্থাৎ যে, যে কাজে নিযুক্ত তার পরিবারের লোক সেই কাজের সাথে মন্দিরে যুক্ত থাকেন, যেমন যারা ভোগ রান্না করেন,পুরোহিত, ধ্বজাবাহক তারা পারিবারিক ধারানুযায়ী এই কাজ করেন, তেমনি যারা এই রথ তৈরী করেন তারা পারিবারিক ধারা অনুযায়ী রথ তৈরী করেন।
এবার আসি রথ প্রস্তুতির কথায়। ২০০ জন মতো কামার, ছুতারমিস্ত্রি, দর্জি, শিল্পী এই কাজে যুক্ত হন তবে বংশপরম্পরায়। ৫৮ দিনের নির্ধারিত সময়সীমায় অক্লান্ত পরিশ্রমে এই কাজ সম্পন্ন হয়। রথের কাঠামো নির্মাণের অধিকারী ছিলেন একটি মাত্র পরিবার যারা ওই ঐতিহ্য আজও বজায় রেখেছেন। এই পুরো বিষয়টা হিন্দু পঞ্জিকা মতে বিশেষ দিনে সম্পন্ন হয়। ওড়িশা সরকার রথ তৈরীর জন্য বিনা মূল্যে ৪০০০ কাঠ যোগান দেন, বসন্ত পঞ্চমী অর্থাৎ সরস্বতী পূজার দিন ওই কাঠ মন্দিরের বাইরে দেওয়া হয়। সেই কাঠ রথের প্রয়োজনীয় মাপের বানানোর জন্য রামনবমীর দিন করাতকলে পাঠানো হয়। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মন্দিরের বাইরে রাজবাড়ির সামনে রথের কাঠামো তৈরী হয় এবং ঐদিন চন্দন যাত্রা শুরু হয় (৪২ দিনের), ওই কাঠামো নির্মাণের আগে মন্দিরের পুরোহিতরা সংগীতের মাধ্যমে অগ্নি উৎসব পালন করেন এবং চন্দন যাত্রার শেষ দিনে চাকা লাগানো হয়। চাকাগুলো ঐতিহ্যশালী ভাস্কর্যের আকারে সুন্দর করে রং করা হয়। মোট ৪২টি চাকা তৈরী হয়। ওই রথ তৈরী দেখতেও বহু মানুষ আসেন ।
মন্দিরের ভাস্কর্যের অনুকরণে এই রথের কাজ সুক্ষ ভাবে করার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত কারুশিল্পী নিয়োগ হয়। ১২৫০ মিটারের লাল, হলুদ, কালো, সবুজ চাঁদোয়া ব্যবহার হয়, জগন্নাথের বিশ্রামের জন্য তৈরী হয় কুশন। রথযাত্রার আগের দিন বিকেলে মন্দিরের সিংহ দুয়ারের সামনে আনা হয় সুসজ্জিত রথ, উৎসবের দিন সকালে('গুন্ডিচা') জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা তিনজনকে মন্দিরের বাইরে এনে রীতি অনুযায়ী স্থাপন করা হয় রথে। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রধান পুরোহিত ও রাজা গজপতিদেবের হাত ধরে প্রাণ প্রতিঠিত হয়, শুরু হয় যাত্রা। এই উৎসবে রাজা পথে নেমে ঈশ্বরের যাত্রার পথ প্রস্তুত করেন। একমাত্র এই উৎসবেই রাজা আর সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়|
প্রত্যেকটি রথের আলাদা করে তাৎপর্য আছে, আছে নাম। জগন্নাথের রথ নন্দীঘোষ। উচ্চতা ৪৫ ফুট হলুদ ও লাল রঙের এই রথ ৪৩২ টি কাঠের সমন্বয়ে তৈরী, রথের চূড়ায় থাকে ত্রৈলোক্য ধ্বজা, ১৬টি সাদা ঘোড়া ৯ জন দেবতা (বরাহ,গোবর্ধন, গোপীকৃষ্ণ, নরসিংহ, রাম নারায়ণ, ত্রিবিক্রম হনূমান, রুদ্র), প্রহরী গরুড় এবং সারথি দারুক।
বলরামের রথ : সবুজ ও লাল রঙের ৪৫ ফুট উঁচু এই রথ ৭৬৩টি কাঠ দিয়ে তৈরী, ১৬ টি কালো ঘোড়া এর চালক, নাম তালধ্বজা, ১৪ টি চাকা, সারথি মিথিলা, ৯জন অধিষ্ঠিত দেবতা হলেন গনেশ, কার্তিক, সর্বমঙ্গল, প্রলম্বরী, হস্তযুধ, মৃত্যুঞ্জয়, নাটম্বর, মুক্তেশ্বর, শীষদেব। রথের রশি বাসুকি নাগ রূপে অনুমিত হন।
সুভদ্রার রথ : ৪৪ ফুট উঁচু, ১২ চাকার এই রথ কালো ও লাল রং সুসজ্জিত, লাল ঘোড়া ও সারথি অর্জুন, রথের নাম দেবদালান। অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন চান্দি, চামুন্ডা, ও উগ্রতা ,ব্যানাদুর্গা, সুলিদুর্গা, বারাহী,শ্যামাকালী, মঙ্গলা ও বিমলা।
এই রথের বিবরণ পাই কথ উপনিষদে এবং এই মন্দিরের আকারে নির্মিত রথের আকর্ষণ ৩ দেবতা যাদের ৯ -১২ বছর বাদে নবকলেবর হয়। রথের পর ওই কাঠামো ভেঙে তা রান্নাঘরের কাজে উনুন ধরাতে ব্যবহৃত হয়, এতো বড় রান্নাঘর যেখানে প্রতিদিন ৫৬ রকম পদ ১লক্ষ লোকের জন্য বানানো হয়। কিন্তু এই বাহ্যিক ব্যাখ্যার বাইরে রথকে বলা হয় সমাজ এবং এই রথ নির্মাণের অর্থ সমাজের সমস্ত শ্রেণীর মানুষ একটি উৎসবে একত্রিত হয়ে থাকে। এই রথ দেহ, অধিষ্ঠিত দেবতা তার আত্মা এবং সারথি হলো জ্ঞান যা চিন্তা ও মননকে নিয়ন্ত্রণ করে, আবার রথের চাকা হলো নির্দিষ্ট লক্ষ্য যা মানুষ নিজেই তৈরী করে। রথে বিরাজমান ঈশ্বর রথকে প্রাণবন্ত করে তোলে তাই রথ স্পর্শ ভক্তগণের কাছে মহানমহাপূণ্যের। একাধিক ব্যাখ্যা থাকলেও এই উৎসব অত্যন্ত পবিত্র উৎসব যা রাজা ও সকলের সাহচর্যে পূর্ণতা পায়।