গঙ্গা তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেলুড় মঠ। পতিতপাবনী গঙ্গা বয়ে চলেছে। সম্মুখে রয়েছে তিনটি মন্দির, একটিতে আছেন মা, অন্যটিতে স্বামীজি বিবেকানন্দ আর তৃতীয়টিতে রয়েছে রাজা মহারাজ। স্বামী ব্রহ্মানন্দ, ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের মানসপুত্র। তিনিই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম সঙ্ঘাধ্যক্ষ। আজীবন তিনি এই পদ অলংকৃত করেছিলেন। সঙ্ঘ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর রাজার মতো পরিচালন ক্ষমতা দেখে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নাম দেন 'রাজা'। সেই থেকে সংঘে তিনি 'রাজা মহারাজ' নামে পরিচিত হন।
গুরুর মৃত্যুর পর তাঁর নামে প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেন স্বামীজি। রামকৃষ্ণদেবের দেহত্যাগের পর কলকাতার বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে এক সভায় স্বামীজি রামকৃষ্ণ মিশন গঠনের প্রস্তাব দেন। দিনটা ছিল ১৮৯৭ সালে ১ মে। ৫ মে সঙ্ঘের নামকরণ হয় রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন। ১৯০৯ সালে আইনি স্বীকৃতি পায় রামকৃষ্ণ মঠ। বেলুড় মঠ হল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয়। ধর্ম, সেবা ও শিক্ষা, এই তিন মন্ত্র নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রা শুরু। সেই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ। ব্রহ্মানন্দ পরিচিত ছিলেন 'রাজা মহারাজ' নামে। কারও কারও কাছে তিনি ছিলেন 'রাখাল মহারাজ'। স্বামী ব্রহ্মানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল রাখালচন্দ্র ঘোষ। স্বামী বিবেকানন্দের চেয়ে ন'দিনের বড়, রাখাল মহারাজের জন্ম ঘোষ পরিবারে, ১৮৬৩ সালে। বাবার নাম আনন্দমোহন ঘোষ।
তিনি জন্মেছিলেন উত্তর চব্বিশ পরগনার শিকড়া-কুলীনগ্রামে। মাত্র ১২ বছর বয়সে কলকাতায় এসেছিলেন পড়াশোনা করতে। সেখানেই নরেনের সঙ্গে প্রথম আলাপ রাখালের। ব্রাহ্মসমাজে তাঁকে নিয়ে যান বন্ধু নরেন। নরেনের কথায় রাখাল যোগ দেন ব্রাহ্মসমাজে। বাল্যবিবাহের রীতি মেনে রাখালের বিবাহ হয়েছিল অনেক কম বয়সে। স্ত্রীর নাম বিশ্বেশ্বরী। স্ত্রী বিশ্বেশ্বরীর দাদা মনোমোহন মিত্র ছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। তিনি রাখালকে একদিন নিয়ে গেলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। বদলে গেল রাখালের জীবন। দক্ষিণেশ্বরে আসাযাওয়া বাড়ল। তিনিও অন্যদের মতো ঠাকুরের দ্বারা প্রভাবিত হলেন। জমিদারি, সংসার সব ছেড়ে তিনি হয়ে উঠলেন রামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীর মানসপুত্র। ত্যাগী ভক্তদের সঙ্গে শ্যামপুকুর, কাশীপুর উদ্যাগবাটিতে পড়ে থেকে তিনি ঠাকুরের সেবা করলেন। ঠাকুর স্বয়ং রাখালকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। ১৮৮৬ সালে ঠাকুরের মহাসমাধির পর বরাহনগরে প্রথম রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন রাখালও মঠে যোগ দেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ।
নরেন দলপতি তাঁর রাখাল ছিলেন সূত্র। সূত্রধর হয়ে তিনি গোটা সঙ্ঘকে বেঁধে রেখেছিলেন। বেলুড় মঠ তৈরির অন্যতম রূপকার ছিলেন রাখাল। স্বামীজি পরবর্তী সময়ে তিনিই ছিলেন রামকৃষ্ণ আন্দোলনের মুখ। স্বামীজির প্রতিটি পরিকল্পনা সফল করার অন্যতম চালিকা শক্তি। উদ্বোধন হোক বা মঠে দুর্গা পুজো, প্রতিটি কর্মযজ্ঞে পৌরহিত্যের ভূমিকায় দেখা যেত তাঁকে। বেলুড় মঠের প্রথম দুর্গাপুজোয় স্বামীজির সঙ্গে পুজার বিভিন্ন কাজে সাহায্য করেন রাজা মহারাজ। স্বামীজিকে তিনিই কলকাতায় প্লেগের কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। তারপর শুরু হয় প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াই। ময়দানে নেমে নেতৃত্ব দেন নিবেদিতা ও ব্রহ্মানন্দ।
স্বামীজির বন্ধু ছিলেন রাখাল, দুই বন্ধুর মান-অভিমান লেগেই থাকত। স্বামীজির কাছে বকুনি খেয়ে অভিমানে রাজা মহারাজ কেঁদেছেন, আবার বন্ধুর নেতৃত্বে কাজ করেছেন। বন্ধু আরোগ্য লাভের কথা চিন্তা করে হাওয়া বদলে পাঠিয়েছেন, বেলুড় মঠ জুড়ে বাতাবি লেবুর গাছও রোপণ করেছেন। এ বন্ধুত্বে মিশে ছিল ভালোবাসা, স্নেহ এবং শ্রদ্ধা। স্বামীজিও রাজা মহারাজকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। স্বামীজি স্বয়ং বলেছেন, "রাজা, ঠাকুর তোমাকে কত আদর করতেন, ভালোবাসতেন, সেই তোমাকেই আমি বকি, কত কটু কথা বলি,আমি আর তোমাদের কাছে থাকবার যোগ্য নই।" রাজা মহারাজ স্বামীজির চোখ মুছিয়ে বলেছেন - "তুমি ভালবাসো বলেই বকো, বুঝতে পারি না বলে অনেক সময় কান্না পায়।" এতটাই উষ্ণতা ছিল দুই বন্ধুর সম্পর্কের মধ্যে। অনেক সন্ন্যাসী মঠ তৈরির বিরোধিতা করেছিলেন। এই সময় স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজিকে নানান বিষয়ে সাহায্য করেন, পাশে দাঁড়ান স্বামীজির সিদ্ধান্তের রূপায়নের।
সন্ন্যাস জীবনেও রাজা মহারাজ ছিলেন চূড়ান্ত সফল। পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর হয়ে বারাণসী, ওঙ্কারনাথ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার প্রভৃতি তীর্থস্থান দর্শন করেছে, অদ্বৈততত্ত্বের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন। দিনের পর দিন তিনি সমাধিস্থ হয়ে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তিনি।
ঠাকুর, মা, স্বামীজি একে একে চলে গিয়েছেন কিন্তু তাঁদের রাখাল এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সঙ্ঘকে। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ ব্রিটিশ সরকারের রোষে পড়েছিল, প্রায় নিষিদ্ধ হওয়ার উপক্রম তখন তিনিই ত্রাতা হয়ে রক্ষা করেন সঙ্ঘকে। প্রতিটি সংকট উতরে দেন একার হাতে। স্বামীজির মৃত্যুর পর নিবেদিতার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ। কিন্তু নিবেদিতার পাশেও ছিলেন রাজা মহারাজ। দলপতি নরেন্দ্রনাথের সেনানায়ক হয়ে রামকৃষ্ণ মিশন নামক মহীরূহকে লালন করেছেন রাজা মহারাজ ব্রহ্মানন্দ।