দ্যি ওয়াল, রাহুল দ্রাবিড়

রাহুল দ্রাবিড়, নামটা শুনলেই মনে পড়ে শক্তিশালী ক্ষিপ্র গতির বলকে স্মিতভাবে থামিয়ে দেওয়া এক ব্যাটসম্যান। বাইশগজ, লাল বল আর তিনটি উইকেট তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছে। তাঁর টেকনিক, ক্রিকেটিয় অনুশীলন, শৃঙ্খলায় মুগ্ধ বিশ্ব। ভদ্রলোকের লেখা ক্রিকেটের আদ্যন্ত ভদ্রলোকটির উদাহরণ তিনি। খেলোয়াড় জীবনে প্রতিপক্ষ বোলাদের সম্ভ্রম আদায় করেছেন। তিনি ক্রিজে ব্যাট করলে মনে হত, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যেন মন দিয়ে ছবি আঁকছেন। ক্রিকেট শিল্প হলে, সেই শিল্পের সবচেয়ে বড় শিল্পী তিনি। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল ছাড়া আর ডিফেন্সে ঘাতক বাউন্সারকে ঘায়েল করতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ।
 
বাইশগজে পড়ে থেকে ভারতের স্কোরবোর্ডকে তিনি টেনে গিয়েছেন দীর্ঘদিন। ভরসার নাম দ্রাবিড়! দ্রাবিড় যতক্ষণ ক্রিজে আছেন, ততক্ষন নিশ্চিন্তে থাকতেন ভারতীয় ক্রিকেটের অনুরাগীরা। ভারতের নির্ভরযোগ্য ব্যাটটির মালিকের নাম দ্রাবিড়। ভারতীয় তথা বিশ্ব ক্রিকেট তাঁকে দ্যি ওয়াল বা মিস্টার ডিপেন্ডেবল নামে চেনে। তাঁর ব্যাটিং টেকনিক, নবীন শিক্ষাবনিশ ক্রিকেটাদের কাছে যেন 'ব্যাকরণ' বইয়ের সমান। ভারতীয় ক্রিকেট দলকে দেড় দশক ধরে অসংখ্যবার বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন ত্রাতা রাহুল।
 
 
Rahuldravid1
 
 
আজকের দিনে, ১৯৭৩ সালের ১১ই জানুয়ারী এক মারাঠি পরিবারে ভারতীয় ক্রিকেটের মিস্টার ডিপেন্ডেবেলের জন্ম হয়েছিল। মধ্যপ্রদেশে জন্ম হলেও রাহুলের বেড়ে ওঠা কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে, তাঁর বাবা একটি জ্যাম প্রস্তুতকারী সংস্থায় চাকরি করতেন। সেই কারণেই দ্রাবিড়ের সতীর্থরা তাঁকে জ্যামি বলে ডাকতেন।
 
দ্রাবিড়ের মা ছিলেন বিশ্বেশ্বরায়া কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। ১২ বছর বয়সে থেকে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলেন দ্যি ওয়াল। ১৯৯৬ সালের জুন ইংল্যান্ড সফরে গেল ভারত, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেই লর্ডসের মাঠে একই ম্যাচে অভিষেক হল দ্রাবিড়ের। ঐ ম্যাচে সৌরভের দুর্দান্ত শতরানের চাপে ঢাকা পড়ে যায় দ্রাবিড়ের গুরুত্বপূর্ণ ৯৫। রাহুলের সাথে এমনই হত, ইডেনে লক্ষনের ২৮১ এর আড়ালে থেকে গিয়েছিল রাহুলের অপরাজিত লড়াই।
 
 
Rahuldravid2
 
 
পরবর্তীতে সেই দ্রাবিড়ই সৌরভের পরে ভারতীয় দলের অধিনায়ক হন। উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে শিকারও করেছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা স্লিপ ফিল্ডার রাহুল দ্রাবিড়। টেস্ট ক্রিকেটে সবথেক বেশি ক্যাচ ধরার রেকর্ডও রয়েছে রাহুল দ্রাবিড়ের দখলে। নিজের টেস্ট কেরিয়ারে ১৬৪টি ম্যাচে মোট ২১০বার শূন্যে ওঠা বল তালুবন্দি করে বিপক্ষের বাটসম্যানকে সাজঘরে পাঠিয়েছেন দ্রাবিড়। ১৯৯৬-তেই এক দিবসীয় ক্রিকেটেও দ্রাবিড়ের হাতে খড়ি হয়। ৩০০-এর বেশি একদিনের ম্যাচে দশ হাজারের উপর রান সংগ্রহ করেছেন, ভারতীয় জার্সিতে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেলেছেন। চুটিয়ে খেলেছেন আইপিল। অধিনায়কত্ব করেছেন, আবার দ্রোনাচার্য হয়ে শিখিয়েওছেন।
 
তবে সাদা জার্সিতে দ্রাবিড় বরাবার দৈত্যের মতো সংহার মূর্তি ধারণ করেছেন। ১৬৪টি টেস্ট খেলে ৩৬টি শতরানসহ তাঁর ঝুলিতে ১৩ হাজার ২৮৮ রান। রানের গড় ৫২.৩১। যা সারা বিশ্বের ক্রিকেটারদের কাছে ঈর্ষনীয়। সব টেস্ট খেলিয়ে দেশে গিয়ে শতরান করার নজির রয়েছে তাঁর। রাহুল দ্রাবিড়ই বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার, যে সমস্ত টেস্ট খেলীয় দেশের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছিলেন। অর্থাৎ তদানিন্তন সময় যে ১০টি দেশে টেস্ট খেলত, তাদের সকলের বিরুদ্ধেই শতরান করেছে ভারতীয় ক্রিকেটের ওয়াল।
 
 
Rahuldravid3
 
 
টেস্ট ক্রিকেটের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তিন নম্বর পজিশানে ব্যাট করতে নামতেন দ্রাবিড়। দলকে মজবুত শুরুয়াৎ যোগাতেন। তিন নম্বর জায়গায় ব্যাট করে, বিশ্বের সবথেকে বেশি রানের মালিক রাহুল দ্রাবিড়। তিন নম্বরে ব্যাট করে দ্রাবিড় ২১৯ ইনিংসে ৫২.৮৮ গড়ে, ১০ হাজার ৫২৪ রান করেছেন। ঐ স্থানে ব্যাট করে ২৮টি সেঞ্চুরিহাফ সেঞ্চুরি ৫০টি করেছেন।
 
রাহুল দ্রাবিড় একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার যার একটানা ৪টি ইনিংসে শতরান রয়েছে। ২০০২ সালে নটিংহাম, লিডস এবং দ্য ওভালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ১১৫, ১৪৮, ২১৭ রান করেছিলেন এবং তারপর দেশে ফিরে মুম্বইতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১০০রান করেন। এমন নজির আর কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারের নেই। 
 
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভারতীয় দলের অন্যান্য ক্রিকেটারের সঙ্গে পার্টনারশিপের নিরিখেও বিশ্বের সবথেকে বেশি পার্টনারশিপ রানে শীর্ষে নাম রয়েছে রাহুল দ্রাবিড়ের। ভারতীয় ক্রিকেটে যেকোনও বড় পার্টনারশিপে নাম রয়েছে তার। পার্টনারশিপে মোট ৩২,০৩৯ রান রয়েছে দ্রাবিড়ের ঝুলিতে। যেকোন এক ক্রিকেটারের সঙ্গে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপের সংখ্যার নিরিখে একেবারে শীর্ষ রয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। ক্রিকেটার জীবনে দ্রাবিড় মোট ৮৮ জনের সঙ্গে ব্যাট করেছেন। তারমধ্যে সচিন তেন্ডুলকের সঙ্গে রাহুল দ্রাবিড়ের ২০ টি শতরানের পার্টনারশিপ হয়েছে
 
 
Rahuldravid4
 
 
একদিনের ক্রিকেটের পার্টনারশিপেও রাহুল দ্রাবিড় নজির স্থাপন করেছেন। তিনি একমাত্র ব্যাটসম্যান একদিনের ক্রিকেটে যার দুটি ৩০০ রানের পার্টনারশিপ রয়েছে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টনটনে সৌরভের সঙ্গে জুটি বেঁধে ৩১৮ রানের ইনিংস গড়েন রাহুল দ্রাবিড়। ঐ বছরই ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সচিন তেন্ডুলকর ও রাহুল দ্রাবিড় জুটি বেঁধে ৩৩১ রানের পার্টনারশিপ গড়েছিলেন। কেবল রান নয়, রাহুল দ্রাবিড় টেস্টে সর্বাধিক বল খেলার দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন
 
ক্রিকেটার জীবনে ১৬৪টি টেস্ট ম্যাচে, মোট ৩১২৫৮ টি বল খেলেছেন রাহুল। যা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক অনন্য নজির। বিশ্ব সবথেকে বেশি সময় ক্রিজে কাটানো খেলোয়াড়ও তিনি। ক্রিকেটার জীবনে ৪৪,১৫২ মিনিট ক্রিজে কাটিয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়
 
২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ান রাহুল দ্রাবিড়। এর পরে মাইক হাতে বিশ্লেষকের ভূমিকাতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। সেখান থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের দ্রোনাচার্য ভূমিকায় আবতীর্ণ হন দ্রাবিড়। ​​বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। কোচ হিসাবে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আগামী দিনের ক্রিকেটার তৈরির কাজ করে গিয়েছেন দীর্ঘদিন। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ ভারতীয় ক্রিকেটের আগামী দিনের তারকাদের খুঁজে এনেছে। আজ ভারতের জাতীয় দলের গুরু দ্রোনাচার্যের ভূমিকায় তিনি
 
তিনিই তো সেই ভরসার দেওয়াল, যাঁর উপর ঠেস দিয়ে লড়াই করা যায়। শুভ জন্মদিন ক্রিকেটের ওয়াল, শুভ জন্মদিন আমাদের নব্বইয়ের দশকের সুপারহিরো।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...