শিবরাত্রির টানে ভূতনাথ মন্দির-এর পানে
শ্মশানে যাওযার আগে মৃতদেহকে এই মন্দিরের শিবের জল খাওয়ালে স্বর্গ প্রাপ্তি ঠেকাতে পারেননা স্বয়ং যমরাজ।
আনুমানিক আড়াইশ বছর এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে উত্তর কলকাতার এই মন্দির।
বারানসীর কোনও এক অঘোরী সাধু। নাম নিয়ে মতান্তর আছে। পা পড়ল হুগলী নদীর তীরে। নিমতলা মহা শ্মশান -এ ।তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত হল শিব লিঙ্গ।
সেই শিব লিঙ্গ ঘিরেই বর্তমানের ভূতনাথ মন্দির। ফি বছর শিবরাত্রিতে সেখানে উপচে পড়ে ভক্তের ভিড়। আবার সেই ভিড়ে কি শুধুই ভক্তদেরই সমাগম?
সেই সন্দেহের কোনও অবকাশই দেননা শহরবাসী। লাঠি হাতে এবং কোলে চড়ে, ভিড়ে চোখে পড়বে সব বয়সের মানুষ। কেউ এসেছেন ঈশ্বরের টানে। কেউ আবার জাঁকজমক গা এলিয়ে দিতে।
ভোর-রাত থেকেই গোটা এলাকা জুড়ে ম-ম করছে ঈশ্বরের সুবাস। ভোলানাথ বিরাজমান সর্বত্র। দেবকুলে নাকি তিনি ছিলেন একসময় ব্রাত্য! অথচ কোটি কোটি মানুষের আশার ভোর কেন্দ্র এখন তাঁকে ঘিরেই।
ভিড় মানেনা কোনও জাতপাতের বেড়াজাল। অগুনতি মানুষ হাঁটছেন মন্দির দর্শনে। ভিড়ে ধাক্কা ধাক্কি করতে গিয়ে উঁচু জাতের কোনও ব্রাহ্মণকে সামলাচ্ছেন হয়ত নিচু সম্প্রদায়ের কোনও ব্যক্তি।
মুখে হাসি আর হাতে উষ্ণ করমর্দন। মনে শুধু একটাই নাম। ভোলা মহেশ্বর। সবাই মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছেন তাঁর ডাকে।
রাস্তার দুধার জুড়ে সারি সারি দোকানের পসার। চায়ের দোকানে ধোঁয়ার সঙ্গে গরম গরম লিত্তি। আলো ঝলমলিয়ে যেন গোটা গঙ্গা জেগে ওঠে।এভাবেই জীবন্ত হয়ে ওঠে আহিরিটোলার ভূতনাথ মন্দির।
১৯৩৪ সাল থেকে ভূতনাথ মন্দিরের যাবতীয় দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন হিন্দু সৎকার সমিতি। বর্তমানে মন্দিরের পুজা পরিচালনার দায়ভার তাঁদেরই কাঁধে।
মন্দির ঘিরেই নিমতলা আদি শ্মশান। একসময় ইংরেজ সরকারের চক্ষুশূল হয় এই শ্মশান। সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও ছিল।
বাঁধ সাধেন এক বাঙালি। বাঙালী খ্রিস্টান রেভারেন্ট কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রিটিশ সরকার আর নিমতলা শ্মশান সরিযে নিযে যেতে পারলেন না।
এই শ্মশান ঘাটেই দাহ হয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরই দক্ষিণ দিকে অবস্থিত আড়াইশ বছরের প্রাচীন শ্রীশ্রীভূতেশ্বর মন্দির ।
মন্দিরের ভীত প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিলেন মল্লিক সম্প্রদায়। পেশায় তাঁরা ছিলেন ডোম। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মন্দিরটি ছিল তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে।
ভারতবর্ষে অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের মত শিবরাত্রি ঘিরেও একই উন্মাদনা চোখে পড়ে। শিবরাত্রির আগের দিন দুপুরে আলুনি নিরামিষ পদ দিয়ে ভাত খাওয়া। সেদিন রাতে শুধু জল খেয়ে শুয়ে পড়া।
ফাগুন কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী ছেড়ে যাওয়ার আগে শিবের ব্রত কথা শুনে ব্রাহ্মণকে ভুজ্য দান এবং দক্ষিণা দিয়ে হয় উপোস ভঙ্গ। শিবরাত্রির দিনে পাড়ার মন্দিরে শিবলিঙ্গে সূর্যাস্তের পরে জল ঢালা।
রাতে কলা, নারকেল, গন্ধ লেবু, লঙ্কা দিয়ে ভেজানো সাবু মেখে খাওয়া। শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য লাগে কাঁচা দুধ, দুটো বেল, কলা, আকন্দ ফল, ধুতরো ফুল এবং মালা, বেলপাতা, দূর্বা।
শিবরাত্রি নিয়ে অনেক মিথ বা লেজেন্ড প্রচলিত আছে। কথায় বলে, কিংবদন্তী এক কথায় শিক্ষণীয়।
কাশীর এক ব্যাধ। শিকার করে ফিরছেন। ক্লান্ত পথিক ঠিক করলেন একটু জিরবেন। শিকারগুলো একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে কাছের একটা গাছের ডাল বেয়ে চড়লেন উপরে।
সেটা ছিল বেল গাছ। রাতে এপাশ ওপাশ হওয়ার সময় বেল ফুল ছিঁড়ে নীচে পড়ে। নীচে ছিল একটি শিবলিঙ্গ। দিনটা ছিল শিব চতুর্দশী।নিজের অজান্তেই ব্যাধ ব্রত পালন করেছিলেন।
বেশ কয়েকবছর পর। তিনি মৃত্যু শয্যায়। যমদূত আর শিব দূত এসেছেন তাঁকে নিতে। কে নেবেন, তাই নিয়ে বাঁধল গোল। শিবের আদেশে তিনি গেলেন শিবলোকে।
কারণ?অই বহুদিন আগে রাতে নিজের অজান্তেই শিব চতুর্দশী পালন।এই বিশ্বাস কে কেন্দ্র করেই আপামর মানুষ পালন করেন শিবরাত্রি। পুণ্য লাভের আশায়। শিবলোকে যাওয়ার সাধে।
শিবরাত্রির আকর্ষণ এখন ঘরে ঘরেই। সদ্য স্কুলে পড়া যুবতীও মায়ের সঙ্গে রাখছে উপোষ।কেউ কারণে, কেউ আবার অকারণে। স্কুল-কলেজে পাঠরতা কোনও মেয়েকে কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তার মুখে বাঁধন খোলা লজ্জার হাসি।
হাসি কান্নায় এভাবেই দেবাদিদেব স্থান দখল করেছেন আমাদের মনে। সাম্প্রতিক কালের আমিশ ত্রিপাঠির মেলুয়া কাহিনির দৌলতে রুদ্রদেব বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন জেন ওয়াইয়ের মনে।