ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন 'ভেলুর কন্যারা'

সন ১৯৫৬। ফেব্রুয়ারী মাস। একদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল ভেলুরের মানুষের। তামিলনাড়ুর ত্রিচুর এলাকার বিখ্যাত মন্দিরগ্রাম ভেলুর। মাঝরাতে জেগে মানুষ দেখল ২৩ কন্যার এক শোভাযাত্রা চলেছে ভেলুরের মনিমালারকাভু দেবী মন্দিরের সামনে। 

মালায়লাম ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটা কুম্ভবারনী। ভেলুর মন্দিরে অশ্ব উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

মেয়েদের সেই শোভাযাত্রায় ২২ জন সঙ্গীর সঙ্গে মীনাক্ষীও ছিলেন। মনের মধ্যে উৎসবের আমেজের সঙ্গে চাপা আশঙ্কাটাও এড়াতে পারছিল না। এই শোভাযাত্রাটা অন্যান্য বছরের তুলনায় যে একেবারেই আলাদা! কী হয় কী হয় ভাবটা সবার মধ্যেই ছড়িয়ে আছে শুরু থেকেই। তবে ভয় তারা পাচ্ছে না। সে আর তার তেইশ ‘কমরেড’।

সকলের পরনে মুন্ডম আর নারিয়াত্থাম। কেরালার ঐতিহ্যবাহী দু’পাটের শাড়ী। সঙ্গে গাঢ় লাল ব্লাউজ। গায়ে মানানসই গয়না। হাতের থালায় ঘিয়ের প্রদীপ আর ফুল।

 সঙ্গে সঙ্গে বাজনদাররা চলছে। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে পড়ছে ঢাকের শব্দে।

সময়টা পঞ্চাশের দশক। মাত্র এক দশক হয়েছে ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশ। শাসক বদলের হাওয়া বইছে দেশ জুড়ে। বদল চেয়েছিল ভেলুরের মেয়েরাও। সেই ফেব্রুয়ারী তেমনই এক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছিল ভেলুরের মানুষ। যা বদলে দিয়েছিল ইতিহাস।

ve-1

সেদিনের কিশোরী মীনাক্ষী ভেলারুত্তিল আজ ৮৩ পেরিয়েছেন। অশীতিপর বৃদ্ধা। তবু ভেলুর মন্দিরের গল্প বলতে গেলে টানটান হয়ে ওঠেন। সযত্নে রেখেছেন যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি। যে যুদ্ধ জিততে কোনও অস্ত্র লাগেনি। শুধু লেগেছিল সাহস আর একটা সংস্কারমুক্ত মন।  

 

ভেলুর মন্দিরে তিনদিন ধরে উৎসব। তারই প্রথম দিনে যাচ্ছিলেন এই মেয়েরা। এই প্রথমবার গ্রামের মেয়েরা শাড়ির সঙ্গে সেলাই করা পোশাক মানে ব্লাউজ পরিধান করে মন্দিরে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন! গ্রামের অনেকেই মন্দির চত্বরে বড় ঝামেলার আঁচ করেছিলেন সেদিন। এই মেয়েরা আদৌ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে তো?

সন্দেহ থেকেই যাচ্ছিল।

বিষয়টা যে মোটেই ছোটখাটো নয় তা টের পেয়েই মেয়েদের সঙ্গে ছিল পুলিশি প্রহরা।

গ্রামের গোঁড়া রক্ষণশীল মানুষরা বলেছিলেন এই মেয়েরা মন্দির এবং দেব-বিরোধী কাজ করছে। তারা ছিলেন মূলত নায়ার সম্প্রদায়ের মানুষ।

ve-3

মীনাক্ষী আম্মা বলেন, ‘পুলিশ প্রসাশন আমাদের নিরপত্তা ব্যবস্থা করেছিল। মিছিলের সঙ্গে ছিল এলাকার মুক্তমনা মানুষরা। তাঁরাই প্রথম কথা বলেন মন্দির কমিটির সঙ্গে’।

নাম্বুদিরি আর নায়ার এই দুই উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষরাই কেবল থাকত পারত মন্দির কমিটিতে। তারা মনে করত বাকি সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের দাসবৃত্তি করবে। তারা যা বলবে তাই শুনতে বাধ্য।

মন্দিরে মহিলারা যখন পুজো সারবেন তখন সেলাই করা বস্ত্র পরতে পারবে না। ব্লাউজ ছাড়াই মন্দিরে ঢুকতে হবে।

এই প্রথার বন্ধ হওয়া জরুরী ছিল। মেয়েদের মধ্যে ক্ষোভ ছিলই। এইসব সংস্কারমুক্ত মানুষরা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে গিয়ে মানুষকে বুঝিয়েছিলেন যুগ যুগ ধরে চলে আসে এই প্রথা আসলে মেয়েদের ওপর নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই বন্ধ করতেই হবে।’

একজোট হয়েছিল মানুষ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। ৫৬-র সেই প্রতিবাদ ‘ভেলুর মারাক্কু মারাক্কল’ আন্দোলন নামে চিহ্নিত হয়ে আছে।

ve-2

মীনাক্ষী বলেন, ‘সেদিন আমাদের গেটেই আটকে দেওয়া হয়। এক পুলিশ আধিকারিক মন্দির কমিটিকে বলেন, ‘মেয়েরা ব্লাউজ পরলে দেবী রুষ্ট হবে না, অসুবিধা হবে আপনাদের’।

মন্দির ছিল পুরুষপ্রধান। মহিলাদের থেকে পুরুষভক্ত এবং পুরোহিতদের সংখ্যা অনেক বেশি। সেটা এতটাই যে অস্বস্তি এবং অব্যবস্থার জন্য তরুণী-নাবালিকাদের মন্দিরে যেতে দেওয়ার সাহস পেত না বাড়ির লোক। মীনাক্ষীর নিজেরই অভিজ্ঞতা একই।

 

মীনাক্ষীরা মন্দির কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল তাদের দাবী মেনে নিতে। পরের বছর থেকে সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য খুলে যায় মন্দিরের দরজা। মেয়েদের ‘ব্লাউজ-বারণ’-এর প্রথাও বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। আজ থেকে ৬৫ বছর আগে। ২০২১-এ ‘ভেলুর মারাক্কু মারাক্কল আন্দোলন’ ৬৫ বছরে পা দিল।

ve-4

 পোশাকের অধিকারে দক্ষিণী মেয়েদের প্রতিবাদ আন্দোলন এটাই প্রথম নয়। ‘ভেলুর মারাক্কু মারাক্কল’ আন্দোলনের প্রায় ১০০ বছর আগে নাদার সম্প্রদায়ের মেয়েরা লড়াই করেছিল। ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢাকার অধিকারের দাবীতে।

মীনাক্ষী আম্মা বলেন, ‘আমরা জিতে ফিরেছিলাম’। ভেলুর বিখ্যাত নানা উৎসব আর পার্বণের জন্য। সেই সূত্রেই এই ভূমির নাম ‘ভেলুর’। প্রতিবাদ-আন্দোলনের জন্যই মানুষ বারবার মনে করে এই ভূমির নাম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...