তিনি ছিলেন চিরকালের গান পাগল। গান রচনা করেছেন। নিজে গেয়েছেন। সকলকে গাইয়েছেন। গানের ভুবন দিয়ে দেখেছেন বিশ্বভুবন। গীতবিতানের পাতায় পাতায় তাই শ্রোতার জন্য অপেক্ষা করে অবগাহনের টান। তাঁর গানের ঋতুরঙ্গে প্রিয় ঋতু বর্ষা। বর্ষার সঙ্গে তাঁর মনের যোগ ছিল গভীর। কাছের মানুষরা জানতেন বর্ষা এলেই আশ্চর্য চঞ্চল হয়ে উঠতেন কবি। শান্তিদেব ঘোষ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘বর্ষার দিন এলেই তিনি যে রকম চঞ্চল হয়ে উঠতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে তা বিরল।’
জীবনের শেষ দিকের বছরগুলিতে অসুস্থতার কারণে শ্রবণশক্তি কমে এসেছিল। গান শুনতেও অসুবিধা হত। নতুন গান রচনায় আগের উৎসাহ আর পেতেন না, কিন্তু উৎসুক হয়ে থাকতেন গান শোনার জন্য। আশ্রমের ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই সন্ধেবেলা এসে তাঁকে গান শুনিয়ে যেত। জীবন প্রান্তে প্রিয় হয়ে উঠেছিল প্রথম যৌবনে লেখা গানগুলি। গান শুনতে শুনতে তাঁর মনে পড়ত হারানো দিনের স্মৃতি।
তাঁর জীবনের শেষ বর্ষায় ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন শান্তনিকেতনে বর্ষামঙ্গল আয়োজনের জন্য। সেবার বিপুল সমারোহে বর্ষা নেমেছিল রাঙামাটির দেশে। শ্যামল মেঘের ছায়ায় চঞ্চলা হয়েছিল কোপাই। ভিজেছিল কবির মন। এদিকে উত্তরোত্তর বাড়ছিল অসুস্থতা। তিনি যেন শুনতে পেয়েছিলেন মৃত্যুর পায়ের শব্দ। শ্রাবণেই বিদায় নিলেন কবি। ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮।
১৯২৮ সালে বর্ষামঙ্গল উৎসবের সূচনা করেছিলেন। জীবদ্দশায় কবিবহুবার পালন করেছেন বৃক্ষরোপণ উৎসব। একবার একমাত্র নাতি নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সংবাদ আসায় অনেকে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান বাতিলের কথা বললে তিনি রাজি হননি। এ সম্পর্কে মেয়ে মীরাকে লেখেন, ‘‘নিতুকে খুব ভালবাসতুম, তাছাড়া তোর কথা ভেবে প্রচণ্ড দুঃখ চেপে বসেছিল বুকের মধ্যে। কিন্তু সর্বলোকের সামনে নিজের গভীরতম দুঃখকে ক্ষুদ্র করতে লজ্জা করে। ক্ষুদ্র হয় যখন সেই শোক সহজ জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’’
তাঁর তিরোধানের মাস খানেক পর শান্তিনিকেতন আশ্রমে আয়োজন করা হয়েছিল বর্ষামঙ্গল উৎসবের। বর্ষার গানে সেদিন মিশে গিয়েছিল নীরব বিরহের চোখের জল। কবি চেয়েছিলেন, তাঁর শ্রাদ্ধ হবে শান্তিনিকেতনে ‘ছাতিম গাছের তলায়, বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায়’। সেই ছিল গুরুদেবের প্রতি প্রিয় আশ্রমিকদের বিদায় অর্ঘ্য।
১৩৪৯ বঙ্গাব্দ থেকেই বাইশে শ্রাবণ দিনটি বৃক্ষরোপণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে শান্তিনিকেতনে। ছেলেমেয়েরা বাসন্তী রঙের ধুতি ও শাড়ি পরে ফুলের গয়নায় সেজে কবির বৃক্ষবন্দনা গানটি গাইতে গাইতে বৃক্ষ রোপণ পর্ব স্থলে উপস্থিত হন।
যে গাছের চারাটি রোপণ করা হবে, সেটিকে চতুর্দোলায় আনা হয়। শাঁখ বাজিয়ে মাঙ্গলিক মন্ত্রোচারণে মধ্যে দিয়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। এর পর আশ্রম সঙ্গীত। ২২শে শ্রাবণের পরের দিন শ্রীনিকেতনে ২৩ শ্রাবণ সকালে দুটি হালচাষের বলদকে সাজিয়ে মাঠে আনা হয়। শ্রীনিকেতনে অনুষ্ঠিত হয় ‘হলকর্ষণ উৎসব’।
কবির তিরোধান দিনটির স্মরণে ভারত সরকার ১৯৫০ সাল থেকে এই বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানটি পালন করে চলেছে সারা দেশ জুড়ে।
তথ্য ঋণঃ রবীন্দ্র স্মৃতি