পুরীর জগন্নাথধামের মহিমা অপার, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। আজ উল্টোরথের দিন আমরা একটু আলোচনা করব শ্রীশ্রী জগন্নাথের বিভিন্ন রকম বেশভূষা নিয়ে। তাঁর নিত্যদিনের পূজা, বেশভূষা সবই আলাদা রকম। বিভিন্ন রকম পোশাক, অলংকার, চন্দন, কস্তুরী ইত্যাদিতে ভূষিত থাকতেই পছন্দ করেন প্রভু।
আপনারা জেনে অবাক হবেন, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মাসে তাঁর ভিন্ন বেশভূষা হয় যা দেখতে বড়ই সুন্দর। প্রতিদিনের শুরুতে অর্থাৎ মঙ্গলারতির পর তিনি সজ্জিত হন অবাকাশ বেশে। প্রতিবার ভোগ নিবেদনের পর ফুল, মালা এবং সিল্কের কাপড় সহযোগে তিনি সজ্জিত হন সদাবেশে। দিনে পাঁচবার এই বেশে দেখা যায় তাঁকে। খান্দুয়া নামক সিল্কের তৈরী বিশেষ পোশাকে প্রতি রাতে তিনি বড়শৃঙ্গার বেশ ধারণ করেন। এতো গেল দিনের বিভিন্ন সময়ের বেশ, এবারে দেখে নিই বছরের বিভিন্ন মাসে কেমন বেশ ধারণ করেন তিনি।
বৈশাখে প্রভু জগন্নাথের হয় চন্দনবেশ। প্রতিদিন এই সময় প্রভুর অঙ্গে চন্দন লেপন করা হয়। অক্ষয় তৃতীয়া থেকে ৪২দিন ধরে এই অনুষ্ঠান চলে।
জ্যৈষ্ঠ মাসে দেবস্নান পূর্ণিমায় প্রভুর হাতি অথবা গণেশ বেশ হয়। কথিত আছে, দক্ষিণ থেকে আসা গণেশের পরমভক্ত গণপতি মিশ্র জগন্নাথদেবকে গণপতি রূপে দেখার আশায় এসেছিলেন। ভক্তের ইচ্ছা পূরণের জন্য স্নানপূর্ণিমার দিন কল্পতরু জগন্নাথ গণপতি বেশ ধারণ করেন। এছাড়া জ্যৈষ্ঠ শুক্লা একাদশীতে মদনমোহনের রুক্মিণীহরণ বেশ হয়।
আষাঢ়ের অমাবস্যায় স্নানযাত্রার পর প্রভুর নবযৌবন বেশ হয়। রথযাত্রায় গুন্ডিচা থেকে ফিরে আসার পর শুক্লা একাদশী তিথিতে প্রভুর সুনাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রভু জগন্নাথের এই বেশ রাজরাজেশ্বরের বেশ। সারা বছরে মোট পাঁচবার প্রভু জগন্নাথ এই বেশ ধারণ করেন। আষাঢ়ের একাদশী, বিজয়া দশমী, কার্তিক পূর্ণিমা, পৌষ পূর্ণিমা এবং মাঘী পূর্ণিমায় প্রভুকে এই বেশে দেখা যায়। এই বেশে প্রভু এক কুইন্টালের বেশি সোনা পরিধান করেন। এর মধ্যে শ্রীহস্ত, শ্রীপায়ার, শ্রীমুকুট, শ্রীকুন্তল, শ্রীরাহুরেখা, শ্রীমালা, পদ্মমালা, সেব্যাতিমালা, আগষ্টিমালা, কদম্বমালা, ময়ূরমালা, চম্পামালা, শ্রীচুলা পাতি, শ্রীচিত্ত, শ্রীচক্র, শ্রীগদা, শ্রীপদ্ম, শ্রীশঙ্খ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
শ্রাবণী অমাবস্যায় প্রভুর চিতা লাগি বেশ এবং শ্রাবণী শুক্লা পঞ্চমীতে রাহুরেখালাগি বেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমীর পর দশমী তিথি থেকে প্রভু বিভিন্ন বেশে সজ্জিত হয়ে পূজিত হন। কৃষ্ণা দশমীতে বনভোজন বেশ, একাদশীতে কালিয়দমন বেশ, দ্বাদশীতে প্রলম্বাসুরবধ(শুধুমাত্র বলভদ্রের জন্য), কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে কৃষ্ণ-বলরাম বেশ এবং শুক্লা দ্বাদশীর দিন বলী বামন বেশ ধারণ করেন প্রভু। বামন হলেন বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার।
আশ্বিন মাসের বিজয়া দশমীতে ত্রিমূর্তি রাজবেশে সজ্জিত হন প্রভু। বিজয়ী রামচন্দ্র রূপে বিরাজমান হন ঐদিন শ্রী জগন্নাথ।
কার্তিক মাসের শুক্লা দশমী পর্যন্ত রাধা দামোদর বেশে প্রভু সজ্জিত থাকেন। একাদশীতে লক্ষ্মী নারায়ন বেশ, দ্বাদশীতে বাঁকাচূলা, ত্রয়োদশীতে ত্রিবিক্রমরূপে, চতুর্দশীতে নরসিংহরূপে এবং পূর্ণিমাতে রাজাধিরাজ বেশে প্রভু সজ্জিত হন। কার্তিক মাসে প্রভুর আরো একটি বেশ উল্লেখযোগ্য। সেটি হল প্রভুর নাগার্জুন বেশ। এই সময় প্রভুকে যুদ্ধের বেশে সজ্জিত করা হয়। তবে যে বছর কার্তিকপঞ্চমী তিথি পঞ্চম দিনে পালিত না হয়ে ষষ্ঠ দিনে হয়, সেই বছরই প্রভুর এই নাগার্জুন বেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় প্রভুকে যুদ্ধের বেশে সজ্জিত করা হয়। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম। তিনি নাগার্জুনকে বধ করেছিলেন। ইহার স্মরণেই নাগার্জুন বেশের আয়োজন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৪ সালে শেষবার নাগার্জুন বেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আবার আগামী ২০২০ সালে এই বেশ অনুষ্ঠিত হবে।
পৌষ মাসে প্রভুর হয় পুষ্য অভিষেক বেশ। এই বেশে প্রভুকে ঘোদালগি এবং জমালগি অর্থাৎ শীতলকালীন পোশাক পরিধান করানো হয়। এই সময় প্রভুর পদ্ম বেশও অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার অথবা বুধবার এই বেশ পরানো হয়। মকরসংক্রান্তিতে প্রভু মকরচুলা বেশ পরিধান করেন।
মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী, অমাবস্যা ও শুক্লা প্রতিপদে প্রভু শ্রদ্ধা বেশ ধারণ করেন। মাঘী পূর্ণিমাতে গাজোদ্ধারণ বেশ অনুষ্ঠিত হয়। পুরান অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণু একটি হাতিকে একটি কুমিরের মুখ থেকে রক্ষা করেছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণেই প্রভুর এই বেশ। মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষের চোদ্দতম দিনে প্রভুর শ্রদ্ধা বেশ হয়। এই বেশ সম্বন্ধে পুরাণে বর্ণিত আছে, ত্রিমূর্তি তাঁদের অভিভাবক নন্দ ও বাসুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করেন। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রভু জগন্নাথ ২৭ ফুট, বলভদ্র ২১ ফুট এবং দেবী সুভদ্রা ১৮ ফুট লম্বা কাপড় পরিধান করেন। মাঘ মাসের শুক্লা প্রতিপদ থেকে বসন্ত পঞ্চমী পর্যন্ত এই বেশ পরিধান করা হয়।
ফাল্গুন মাসের দোলের আগে দশমী থেকে চতুর্দশী পর্যন্ত প্রভুর কুন্দল বেশ হয়। এই সময় ত্রিমূর্তিকে বিশেষ ধরণের কাপড় পরানো হয় এবং কানে এক ধরণের গয়না পরানো হয়, যা স্থানীয় ভাষায় কুন্দলা নাম পরিচিত। দোল পূর্ণিমায় শ্রী জগন্নাথকে রাজবেশে সজ্জিত করা হয়।
চৈত্র মাসে রামনবমীতে প্রভুকে শ্রীরামের মত সজ্জিত করা হয়। একে রামরাজা বেশ বা রঘুনাথ বেশ বলা হয়।