কোশলদেবী মগধের রাজা বিম্বিসারের স্ত্রী। অজাতশত্রুর মা ছিলেন। মগধের সিংহাসনের ভাবি অধিকারী ছিলেন অজাতশত্রু।
নারীর ইতিহাস বড় আশ্চর্যের। নারীর ইতিহাসে তাঁদের পরিবার ও সংসারের প্রতি দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতার উল্লেখ বড় উজ্জ্বল। কিন্তু সেই নারীরই অন্য ক্ষেত্রে সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ চমকে ওঠার মত। ইতিহাসে কিন্তু সেটুকু বড় ক্ষুদ্র জায়গা জুড়ে থাকে।
কিছু ক্ষেত্রে নারীর সাংসারিক পরিচালনার ক্ষমতার দক্ষতা দেখে তাঁর বুদ্ধিমত্তার অনুধাবন করা যায়। বোঝা যায় নিছক গৃহকার্য এবং স্বামী, সন্তানের খেয়াল রাখা এসব সুন্দরভাবে রক্ষা করতে গেলেও কতটা দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এমনই এক নারী কোশলদেবী। তিনি যুক্তপ্রদেশের কৌশল রাজ্যের রাজা প্রসেনজিৎ এর বোন এবং মগধেশ্বর বিম্বিসারের স্ত্রী ছিলেন।
গৌতম বুদ্ধের সময়ে তাঁর স্বামী ও ভাই দুজনেই ছিলেন প্রখ্যাত রাজা। তাঁদের বিপুল প্রতিপত্তির আলোয় কোশলদেবীর বুদ্ধিমত্তা ঢাকা পড়ে যায়নি।
ইতিহাস মতে অজাতশত্রু বিম্বিসার ও কোশলদেবীর পুত্র। অজাতশত্রু জন্ম নেওয়ার আগে রাজ্যের গণকেরা গণনা করে বলেছিলেন এই পুত্র তার বাবার মৃত্যুর কারণ হবে। এমনকি অজাতশত্রু গর্ভে থাকাকালীন রানী কোশলদেবীর এক অদ্ভুত ইচ্ছে হত। রানী রাজার ডান হাতের রক্ত পান করতে চাইতেন। জ্যোতিষীরা এই ইচ্ছেকেও অশুভ লক্ষণ হিসেবেই দেখতেন।
স্বামীর সুরক্ষার জন্য রানী নিজেই তার সন্তানকে হত্যা করার কথা বলেছিলেন স্বামীকে। কিন্তু বিম্বিসার ছিলেন নীতি-পরায়ণ, স্নেহশীল রাজা। তাই রানীর কথাতেও সন্তানের কোন ক্ষতি তিনি হতে দেননি।
যথারীতি জন্ম হয় অজাতশত্রুর। স্নেহে, সোহাগে আদরে বড় হতে থাকে সে। একবার শিশু বয়সে অজাতশত্রুর একটি ফোঁড়া হয়েছিল। ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিল ছোট্ট শিশু। রানী কোশলদেবী ও তাকে কিছুতেই সামলাতে পারছিলেন না। শিশু কেঁদেই চলছিল অনবরত। তখন তাকে ভোলাতে রাজসভায় নিয়ে যাওয়া হয়। শোনা যায়, বিম্বিসার নিজে মুখ দিয়ে সেই ফোঁড়াকে গলিয়ে তার রস গিলে ফেলেন। রানী কোশলদেবী অভিভূত হন রাজার এই সন্তান-স্নেহ দেখে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এমন স্নেহশীল বাবাকে হত্যা করা তো দূরের কথা, কোন ক্ষতির চিন্তাও করতে পারবে না তাঁদের সন্তান। অজাত সূত্র বড় হতে থাকে পরিবারের স্নেহে।
এদিকে গৌতমবুদ্ধের এক মামাতো ভাই, দেবদত্ত সেসময় প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকেন। গৌতম বুদ্ধের জনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন দেবদত্ত। দেবদত্ত নিজেও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সেভাবে তাঁর খাতির ছিল না। ঈর্ষার ভাবনার শুরুটা এখান থেকেই।
মগধের রাজা বিম্বিসার অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন গৌতম বুদ্ধকে। বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। বিম্বিসারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন দেবদত্ত। তাঁর মনে হতে থাকে এই বিম্বিসারের জন্যই গৌতম বুদ্ধের এত প্রতিপত্তি। বিম্বিসারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন দেবদত্ত। এই কাজে তিনি ব্যবহার করতে চেষ্টা করেন বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুকে।
দেবদত্তের ক্রমাগত প্ররোচনায় সিংহাসনের প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন অজাতশত্রু। মা ও বাবার কাছে তিনি সিংহাসনে বসার ইচ্ছের কথা জানান। রাজা বিম্বিসার তাঁকে অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু অজাতশত্রুর এমন অদ্ভুত চাহিদা ও বাবার প্রতি দুর্ব্যবহার চিন্তিত করে তুলেছিল কোশলদেবীকে। তিনি তখন বাধা দিয়েছিলেন বিম্বিসারকে। কিন্তু স্নেহশীল বাবা স্ত্রীর কথা অগ্রাহ্য করেন।
সিংহাসনে অজাতশত্রু আসীন হয় রাজা হিসেবে। রাজা হয়ে দেবদত্তের প্ররোচনায় প্রথমেই একটি কারাগারে বন্দি করে নেন বাবাকে। বিম্বিসার গৌতম বুদ্ধের দীক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন। তাই কোন অস্ত্রের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হবে না এটা দেবদত্ত ও অজাতশত্রু ভালো করেই জানতেন। তাঁরা দীর্ঘদিন বিম্বিসারকে খাবার না দিয়ে রেখে দিয়েছিলেন।
এই পর্যায়েই শুরু হয় কোশল দেবীর লড়াই। স্বামীর এমন অবস্থায় মনঃকষ্টে ভুগতে শুরু করেন তিনি। গর্ভের সন্তানকে তিনি নিজেই হত্যা করতে পারতেন যখন জ্যোতিষীরা তাঁকে বারবার সাবধান করেছিলেন। কিন্তু স্নেহের বশে তিনি তা করেননি। এই অনুতাপ কোশলদেবীকে দগ্ধ করতে থাকে। তবে বিম্বিসারের কাছে সারাদিনে একবার যাওয়ার অনুমতি ছিল কোশলদেবীর।
প্রতিদিন যাওয়ার সময় নিজের বুদ্ধিমত্তায় কোনো না কোনোভাবে বিম্বিসারের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন তিনি। প্রথম প্রথম নিজের কাপড়ের আচ্ছাদনের ভেতর খাবার নিয়ে যেতেন। কয়েকদিন পরে ধরা পড়ে যান যথারীতি। নাহ! হাল ছেড়ে দেননি তিনি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজের পায়ের জুতোর মধ্যে করে খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর সেই পন্থাও যখন ব্যর্থ হয়, তারপর রানী কোশলদেবী নিজের মুকুটের মধ্যে করে খাবার নিয়ে যেতেন। তৃতীয় পন্থায়ও কয়েকদিন পরে ধরা পড়ে যান।
শোনা যায় এরপর নাকি খাবার নিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। নিজের গায়ে মধু মেখে নিয়ে যেতেন স্বামীর কাছে। সেই মধু নিজের শরীর থেকে তুলে স্বামীকে খাইয়ে দিতেন যাতে তার জীবন একেবারে শেষ না হয়ে যায়। এই পর্যায়ে ধরা পড়ে যাওয়ার পর কোশলদেবীকে আর বিম্বিসারের কারাগারে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কথিত আছে এরপর একদিন এক নাপিতকে পাঠিয়েছিলেন অজাতশত্রু। সেই নাপিত বিম্বিসারের শরীরের অজস্র শিরা কেটে দেন। আঘাতে-আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন বিম্বিসার। নিজের মৃত্যু প্রার্থনা করতেন তিনি। অবশেষে আঘাতপ্রাপ্ত শরীরে খাবার না পেয়ে মারা যান মগধের রাজা বিম্বিসার।
শোনা যায় সেই দিনই অজাতশত্রুর একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। সেই সন্তানের মুখ দেখেননি রানী কোশলদেবী। স্বামী মারা যাওয়ার পর কয়েকদিন পরে তিনিও পৃথিবী ত্যাগ করেন।
স্বামীকে বাঁচানোর জন্য যে সাহসিকতা ও ভালোবাসার পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন তার জোরেই ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম আজও উজ্জ্বল।