ইমরোজের অমৃতা

দেশভাগ হয়েছে এক দশক আগে। তখন ইংরেজ সাম্র্যাজ্যের যন্ত্রণা দগদগ মানুষের স্মৃতিতে। পরাধীন দেশে শিকলে বাঁধা জীবন তাড়িয়ে বেড়ায় মানুষকে।এদিকে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্নটাও নতুন আশার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

সালটা ১৯৫৭। ডিসেম্বর মাস। দেখা হল অমৃতা আর ইমরোজের। অমৃতা প্রীতম আর ইন্দ্রজিৎ আলিয়াস ইমরোজ।
দুজনের এক বন্ধুর মাধ্যমে। দুজনেই থাকতেন বোম্বাইয়ের পাতাল নগরে। একজন পূর্বে। একজন পশ্চিমে।

ইমরোজ তখন কাজ করছেন উর্দু ম্যাগাজিন ‘শামা’য়। অমৃতা একদিন তাঁর কাছে এলেন নিজের বইয়ের কভার ডিজাইনের জন্য। ইমরোজ এবং অমৃতার গল্পের শুরুটা সেখান থেকেই।

অমৃতা বোম্বে রেডিয়ো স্টেশনে পঞ্জাবী অনুষ্ঠান করতেন। কবিতা লিখতেন নিয়মিত। ইমরোজ পেশাদার চিত্রশিল্পী।
প্রথম দেখার পর একটা কবিতা লিখেছিলেন। কবিতার নাম ‘শাম কা ফুল’। সন্ধ্যের ফুল। প্রথমবার ইমরোজের মুখোমুখি। দেখা একটু দেরী করে হয়েছিল তাঁদের। অমৃতা তেমনভাবেই ভেবেছিলেন।

Amrita1

কবি সাহির লুধিয়ানভীর সঙ্গে একটা এবড়োখেবড়ো সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন অমৃতা। প্রচন্ড ভালবাসতেন অমৃতা সাহিরকে। তার ঠিক পরেই দেখা হয় ইমরোজের সঙ্গে। ইমরোজ চিত্রশিল্পী।

মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় অমৃতার। লাহোরের এক বস্ত্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রীতম সিং-এর সঙ্গে। তারপরেই দেশভাগ। লাহোরে ছেড়ে সপরিবারে চলে আসতে হল বোম্বাই শহরে।

রেডিয়োতে প্রোগ্রাম করতেন অমৃতা। সন্ধ্যেবেলা অনুষ্ঠান। রেডিয়ো স্টেশনের কাছেই ইমরোজের বাড়ি। ছাদ থেকে রাস্তা দেখা যায়। বাস থেকে নামত গভীর চোখের এক মেয়ে। চোখ টেনে নিয়েছিল তার।

ছাদ আর রাস্তার মাঝে বাসের আড়ালটা ইমরোজের একটুও ভাল লাগত না। যেমন ভাল লাগত না অমৃতার বাসে ফেরা। সেই আড়ালটা যাতে আর বিরক্ত না কর তার জন্য একদিন একটা স্কুটার কিনলেন।

ইমরোজ অমৃতাকে বাড়ি অবদি পৌঁছে দিতেন। একসময় স্কুটার বুড়ো হল। জং ধরল তার কলকব্জায়। তখন দু’জনে মিলে গাড়ি কিনলেন একটা।

‘হাউজ-খাস’এ দুজনের বাসা। এক সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন তাঁরা।

Amrita2

সমাজের বেঁধে দেওয়া-রীতিনীতির তোয়াক্কা তাঁরা করেননি। কেউ কাউকে নিয়ম মেনে বলেননি ভালোবাসার কথা। শুধু জানতেন তাঁরা অবিচ্ছেদ্য।

তাই লিখতে পেরেছিলেন, ‘তু মেরা সমাজ, অউর ম্যাঁয় তেরা সমাজ, ইসসে জাদা অউর কোই সমাজ নেহি’।
অমৃতা আর ইমরোজের মাঝখানে ১০ বছরের বয়সের ব্যবধান। কিন্তু কোনও ব্যবধানই বাঁধা হতে পারেনি তাঁদের মাঝে। অমৃতা শুধু ইমরোজকে বলেছিলেন, ‘ এত দেরী করে কেন এলে’।

অমৃতা বয়সের উপান্তে। পাঁজর ভেঙে বিছানা শয্যায়। যন্ত্রণায় অস্থির। প্রতিদিন ইমরোজকে বলতেন, খানিকটা সায়ানাইড ক্যাপসুল এনে দিতে। এ যন্ত্রণা অসহ্য। বদলে ইমরোজ পেইন কিলার ট্যাবলেট এনে দিতেন।

২০০৫-এ চলে যান অমৃতা। ইমরোজ তখন আশি। অমৃতাকে কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও কাছছাড়া করেননি তিনি। ছবিতে, লেখাতে, প্রতিটা মুহুর্তে আগলে রেখেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। সেই স্মৃতির কোনও লয় নেই। ক্ষয় নেই।

দীর্ঘ চারদশক একে অপরের সঙ্গী ছিলেন তাঁরা। বিচ্ছেদে তাই ইমরোজ লিখেছিলেন, “ উয়ো ইয়াহিঁ হ্যায়, ঘর পর হ্যায়, কহিঁ নেহি গয়ি”...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...