বিশ বছর বয়সে ফাঁসির দড়ি বরণ করেছিলেন বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস

বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে বসন্ত কুমার বিশ্বাস কোন ধূমকেতু ছিলেন না। প্রতিবাদ ও সংগ্রাম ছিল তাঁর রক্তে। পিতামহ দিগম্বর বিশ্বাস ছিলেন বাংলা তথা নদিয়ার গৌরব।

নদিয়ার বুকে অত্যাচারী নীলকরের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছিলেন তিনি। অত্যাচারিত কৃষকের পাশে দাঁড়াতে নীলকরের চাকরি ছেড়েছিলেন, সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন, কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাদের হৃত অধিকার। দিগম্বর মারা যান ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে। আর বসন্তের জন্ম হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে।

বাল্যকালে পূর্বপুরুষের বীরত্বের গাথা শুনে শুনে পরাধীন দেশকে ইংরেজের কবল থেকে মুক্ত করার যে স্বপ্ন বসন্তের মনে জেগেছিল, তা-ই বৈপ্লবিক চেতনায় পর্যবসিত হল এক বিপ্লবীর সান্নিধ্যে। সেই বিপ্লবী মুড়াগাছা হাইস্কুলের শিক্ষক ক্ষীরোদচন্দ্র গাঙ্গুলি। মাস্টারমশাই ছাত্র বসন্তের মধ্যে স্ফুলিঙ্গ দেখে নিয়ে এলেন 'যুগান্তর' নামের গুপ্ত সমিতি বা বিপ্লবী সংগঠনে। এই সময় বসন্তের বয়স মাত্র পনের বছর।

সংগঠনে এসে বসন্ত পেলেন অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রাসবিহারী বসুর সান্নিধ্য। রাসবিহারী তাঁকে দেখেই বুঝলেন, বসন্ত নেহাত স্ফুলিঙ্গ নন, তিনি বিপ্লবের লেলিহান অগ্নিশিখা। প্রয়োজন শুধু শিখাটিকে লালন করে উপযুক্ত পরিস্থিতিতে ছড়িয়ে দেওয়ার।

কাজেই, আর দেরি না-করে তিনি ও অমরেন্দ্র বসন্তকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে শুরু করলেন। দিতে গিয়ে দেখলেন যে, বন্দুকে বসন্তের নিশানা অব্যর্থ। তাই দেখে প্রথমটায় অবাক হলেন। তারপর অবশ্য জানতে পারলেন যে, তুতো ভাইয়ের বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করার অভিজ্ঞতা বসন্তের আছে। তখন বসন্তকে তাঁরা শিখিয়ে দিলেন বোমা তৈরির কৌশল। দিলেন লক্ষ্যভেদের প্রশিক্ষণ।

রাসবিহারী একদিকে দেরাদুন বনবিভাগের সরকারি চাকুরে, অন্যদিকে উত্তর ভারতের বিপ্লবী সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত নেতাও।বৈপ্লবিক কাজের জন্য বসন্ত তৈরি হয়ে উঠতেই তিনি তাঁকে লাহোর নিয়ে গেলেন। 'বিপিন দাস' নাম দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন একটি ওষুধ দোকানের কাজে। ছদ্মনাম ও ছদ্মজীবিকার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে বসন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন রাসবিহারীর নির্দেশের।

নির্দেশ এলো, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে। কেননা, এই সময় কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হতেই সেখানে বিশাল এক সমাবেশের আয়োজন হল। ২৫ ডিসেম্বর দিল্লির চাঁদনি চকের রাস্তায় সেই উপলক্ষে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বিশাল শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন বলে জানা গেল।

সংবাদটি জানার পরই রাসবিহারী সেখানেই বোমা মেরে হার্ডিঞ্জকে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করে ফেললেন। ঠিক করলেন, বোমা মারবেন বসন্ত। নির্দেশ পেয়ে দেশমাতৃকার জন্য এতদিনে একটা কাজ করার সুযোগ পেয়ে বসন্ত আনন্দে উত্তেজনায় একেবারে অধীর হয়ে উঠলেন। লাহোর থেকে ছুটে এলেন দিল্লিতে।

রাসবিহারী তাঁকে পরিকল্পনার খুঁটিনাটি সমস্তই বুঝিয়ে দিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বসন্তকে তিনি নিখুঁত একটি মেয়ে সাজিয়ে শোভাযাত্রাঘেঁষা মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে ভিড়িয়ে দিলেন। তারপর হাতির হাওদায় চড়ে সপারিষদ হার্ডিঞ্জ যেই বসন্তর কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন, উল্টোদিকের ভিড়ে থাকা রাসবিহারী অমনি ইশারা করলেন। ইশারায় নির্দেশ পেতেই তক্ষুনি নিজমূর্তি ধারণ করলেন বসন্ত। কাপড়ে লুকানো কালান্তক বোমাটি ছুঁড়ে দিলেন হার্ডিঞ্জের দিকে। দারুণ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বোমা ফাটল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বোমার আঘাতে রক্তাক্ত হার্ডিঞ্জ হাতির হাওদা থেকে লুটিয়ে পড়লেও মরলেন না। মারাত্মক আহত হয়েও বেঁচে রইলেন!

যাই হোক, বোমা ফাটতেই যে বিশৃঙ্খল হুটোপাটি ছোটাছুটি শুরু হল, তার সুযোগে বসন্ত ও রাসবিহারী দু'জনেই নির্বিঘ্নে স্ব-স্ব-স্থানে ফিরে গেলেন। কিন্তু ভাইসরয়ের ওপর হামলা, এ তো কম কথা না। কাজেই দেশের গোয়েন্দা বাহিনী একযোগে নেমে পড়ল জোরদার তদন্তে। তাতে হামলাকারীর নাম না-জানা গেলেও অচিরে ফাঁস হয়ে গেল হামলার পরিকল্পক হিসেবে রাসবিহারীর নাম। এও ফাঁস হয়ে গেল যে, রাসবিহারী সরকারের বনবিভাগের একজন কর্মী।

গোপনসূত্রে সেই খবর পেয়ে রাসবিহারী অবশ্য আগেভাগেই দেরাদুন ছেড়ে লাহোরে পালিয়ে গেলেন। এবং সেখানে আত্মগোপন করে থাকতে থাকতেই ভেঁজে ফেললেন আক্রমণের আর-একটি পরিকল্পনা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী লাহোরের একটি নৈশক্লাবের পার্টিতে উপস্থিত লর্ড গর্ডন ও উচ্চপদস্থ ইংরেজদের সকলকে বোমা মেরে শেষ করে দিয়ে সরকারের মনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইলেন। এ-কাজে তিনি ফের বসন্তকেই কাজে লাগানোর কথা ভাবলেন।

নেতার নির্দেশ পেয়ে বসন্ত ফের উত্তেজনায় অধীর হলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বেরিয়ে পড়লেন অভিযানে। কিন্তু অভিযান ব্যর্থ হল। বিস্ফোরণ হলেও উদ্দেশ্য সফল হল না। তবে গোয়েন্দা বাহিনী কিন্তু দুটি বিস্ফোরণের মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কার করে ফেলল। তাতে আবারও ফাঁস হয়ে গেল অভিযানের পরিকল্পক রাসবিহারীর নাম। সেই সঙ্গে এবার সামনে চলে এল হামলাকারীর নামও। পুলিশ হন্যে হয়ে বসন্তকে খুঁজতে শুরু করল। ঘোষণা করল রাসবিহারী ও বসন্তকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার।

বসন্ত বেগতিক দেখে লাহোর ছেড়ে গোপনে বাংলায় এসে গা ঢাকা দিলেন।

সময়টা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ। গ্রামের বাড়িতে বাবা মারা গেলেন হঠাৎ। খবর পেয়ে বসন্ত বাবার শেষ কাজে শামিল হতে এলেন গোপনে। শ্রাদ্ধের জিনিসপত্রও কিনতে গেলেন গোপনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ে গেলেন।

অবিলম্বে দিল্লির দায়রা আদালতে তাঁকে তোলা হল। বিচারের নামে প্রহসন হল। রাজদ্রোহ, ষড়যন্ত্র ও হত্যার চেষ্টার অভিযোগে চেষ্টা চলল ফাঁসি দেওয়ার। কিন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন তাঁর পক্ষে সওয়াল করে প্রমাণ করলেন যে, বসন্ত বয়সে কিশোর, তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। ফলে, বাধ্য হয়েই দিল্লি হাইকোর্ট বারো বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করল।

কারাদণ্ডের ঘোষণায় আর যাই হোক ইংরেজের রিরংসা মিটল না। তারা লাহোর হাইকোর্টে আপিল করল ফাঁসির জন্য। এবার বিচারের প্রহসন জমে গেল। কাগজে বয়সের কারচুপি করে সরকার প্রমাণ করে দিল বসন্ত হামলার সময় ছিলেন সাবলকই। আদালত আসামীপক্ষকে কোন সুযোগই দিল না। সাততাড়াতাড়ি আদেশ দিয়ে দিল ফাঁসির।

সেই আদেশে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলে ফাঁসি হয়ে গেল বাংলার বীর বিপ্লবী বাংলা মা'র নির্ভীক সন্তান বসন্তের। বসন্ত প্রাণভিক্ষা করলেন না, জীবনের জন্য অশ্রু বিসর্জন দিলেন না, অমানবিক ইংরেজের চোখে চোখ রেখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নিলেন। বিশ বছরের নির্ভীক যুবক ত্যাগের নিশান জুড়ে অগ্নিআখরে লিখে দিয়ে গেলেন একটাই মন্ত্র, 'বন্দে মাতরম'!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...