প্রেম মরসুমে এক অসম্পূর্ণ প্রেম গাথা
কিছু কিছু প্রেম কাহিনী থাকে যেগুলো মৃত্যুর সেপারে গিয়েও অমর।
হাতের ছোঁয়ায় এখন প্রেমের বাস। পছন্দ হলে লাইক বাট্ন প্রেস করুন। না পছন্দ হলে সোয়াইপ করে এগিয়ে যান। আপনার অপেক্ষায় মনের মানুষ...অনেক...কাতারে কাতারে।
বর্তমানের ছবি পাল্টাতে গেলে কখনও অতীতের ফ্রেমে উঁকি দেওয়া সাজে বৈ কী!সে প্রেম বিষাদের হলেও, তাতে অপূর্ণতা থাকলেও; সেই না গুলোকে উপেক্ষা করেই প্রেমের সন্ধান মেলে।
মির্জা-শাহিবান। এরকমই এক গাথা। নিজেদের পথ নিজেরাই খুঁজতে চেয়েছিল। সেই পথে মিলন না হলেও পুনর্মিলন ছিল অবধারিত। পরপারের যে পূর্ণতা, সেই ঠিকানায়।
সপ্তদশ শতাব্দী। কবি পেলুর লেখনীতে প্রথম কাগজে-কলমে এই প্রেমের গল্প গোচরে আসে সাধারণ মানুষের।
পূর্বতন পঞ্জাব এর খেওয়া প্রদেশ। এখন পাকিস্তান।সেই মাটির জঠর আজও সযত্নে লালন করছে মির্জা-সাহিবানের শেষ প্রেম সিক্ত রক্ত।
ফতে বিবি আর খেওয়া খাঁ সম্পর্কে ‘দুধ ভাই-বোন’। এক রক্তের না হয়েও একই মাতৃ দুগ্ধে বেড়ে উঠেছেন দু’জনে। তাই সম্পর্কের এরকম নাম।
পরবর্তীতে ফতে বিবি জন্ম দিলেন পুত্র সন্তান মির্জা। খেওয়া খাঁ জন্ম দিলেন কন্যা সন্তান শাহিবান। মতান্তরে সাহিবা।
এক শহরেই আলাদা বেড়ে উঠতে থাকলেন আগামীর দুই চিরন্তন প্রেমিক-প্রেমিকা। পড়াশুনোর সূত্রে মির্জা আসলেন সাহিবানের বাড়ি।সেই প্রথম চোখে চোখে খুঁজে পাওয়া। দেখতে পাওয়া আগামীকে।
কোরান ক্লাসের একদিন। মৌলবি বেতের আঘাতে লাল করলেন সাহিবানের নরম পাপড়ির মত হাত দুটো।কারণ ভুল উচ্চারণ। দূর থেকে ব্যথা পেলেন মির্জা। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে রাখলেন সাহিবানের হাতের উপর।
শুরু হল প্রেমের গল্প।
একসঙ্গে শুরু হল কোরান পাঠ। কাব্যে, ছন্দে গান বাঁধতে থাকল দুই শিশুমন। যদিও এসব ঘটনার ঘন ঘটা সেই ছেলেবেলার আকাশে ধোঁয়া হয়ে মিশছিল। ভালবাসা কী- তা কেউই বোঝেনা। সম্পর্কে বলতে বন্ধুত্বের দিব্যি।
সময় এগোতে থাকে। একদিন ঘর ফেরত মির্জা ভাবলেন অন্য পথ নেবেন। বাজারের দিকের রাস্তা। সেখানেই অপেক্ষা করছিল সন্ধের চাঁদ। শাহিবান।
দূর থেকে দেখা মাত্রই আর যেন এগোতে পারলেন না মির্জা। আশ্চর্য কিছু দেখে ফেলেছেন যেন! সত্যিই তো তার আগে এমন কোনও রূপ তিনি পৃথিবীতে জেগে থেকে দেখেননি। পুরো স্বপ্নের মত।
ততদিনে থাকার ঠিকানা বদলেছে। বয়স বেড়েছে। বেড়েছে মনের বয়সও। মন বুঝতে শিখেছে সে কী চায়। কেন চায়। এতদিনে মির্জা একজন সুঠাম পুরুষ। ঘোড়সওয়ারি আর তীরন্দাজিতে দক্ষ নাম। সর্বক্ষণের সঙ্গী বলতে বাক্কী। প্রিয় ঘোড়া।
শাহিবান এখন পূর্ণ চাঁদ। অমাবস্যার রাতেও তাঁর আলো ঠিকরে পড়ে চারিদিকে।
অসময়ে ঝড়ের মত একদিন বিয়ে ঠিক হল সাহিবানের। বন্ধুর হাতে চিঠি পাঠালেন মির্জাকে। নিজেকে মির্জা ছাড়া আর কারও হাতে সঁপে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না।
আর অপেক্ষা কীসের! বাক্কির পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়ল নায়ক। বিয়ের আসর থেকেই সবার আড়ালে বের করে আনলেন শাহিবান কে। পথে ক্লান্ত দুই আত্মা একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। একটি গাছের ছায়ায়।
ততক্ষণে জানাজানি হয়ে গিয়েছে তাঁদের বর্তমান অবস্থান। ক্লান্তিতে ঢুলুঢুলু চোখে শাহিবান স্বপ্ন দেখলেন। মির্জার তীরে বিদ্ধ একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে সাহিবানের নিজের লোকেরা।
রক্তপাত তাঁর ভাল লাগেনা। মির্জার অগোচরে তাঁর তীরের মুখ বেঁকিয়ে দিলেন শাহিবান। ভাবলেন অন্তত যদি রক্তপাত ঠেকানো যায়।
ততক্ষণে অতর্কিতে একটি তীর এসে বিঁধে দেয় মির্জার বুক। এসে গিয়েছে সাহিবার আপনজনেরা। প্রথম তীর তাঁরাই ছুড়লেন। বুক ফেটে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিল শাহিবান এর অনিন্দ্য উজ্জ্বল মুখ। সেখানে এখন মির্জার লাল রক্ত লেগে।
এরপরে আসতে থাকে আরও তীর। শেষ লগ্ন এটাই, আঁচ করতে পেরে বুক পাতলেন শাহিবান। প্রেমের রক্তে ভেসে গেলেন দু’জনে, একসঙ্গে। তারায় তারায় লেখা হল নতুন প্রেমের আখ্যান।
কেউ কেউ বিস্মৃতির আড়ালে ঢেকেছেন এই উপাখ্যানকে। কেউ কেউ মির্জার পরিণতির জন্য শাহিবান এর বোকামি কেও দায়ী করতে ছাড়েননি। অন্যান্য অমর গাথার মত এই গাথায় তাই সাহিবানের নাম আগে আসেনা। আগে আসে মির্জা।
সেই বিবাদে ভেসে যাওয়া পাঠকের বা শ্রোতার কম্ম নয়। শুধু চোখ বুজে উপলব্ধিই একমাত্র পথ। প্রেম খুঁজে পাওয়ার গোপন রাস্তাটি সেখানেই। সেখানেই যুক্তি থাকেনা, থাকেনা বোধ; থাকে শুধু আলো। যেই আলো একে অন্যের চোখে পাওয়া যায়।