লেখা পড়ায় দুরন্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার ছাত্রী। মেয়েলিপনা নেই। নাটক করে। লেখার হাত ভালো। ভীষন আড্ডাবাজ। ডাকাবুকো। পাখির মতো ছটফটে। গভীর চোখ দিয়ে দেখে নিতে চায় গোটা দুনিয়াটা। বলগাহীন, মুক্ত এক মেয়ে। নাম কেয়া।
সন ১৯৪২। খিদের জ্বালায় ছটফট করছে বাংলা। তোলপাড় চলছে রাজপথে। শহর যেন হাহাকারপুরী। কান পাতলেই ‘ ফ্যান দাও’ ভাত চাওয়ার সাহস পায়না গ্রামছুট মানুষের দল। পাড়ার মোড়ে ডাস্টবিন ঘিরে পচা খাবারের সন্ধানে কুকুর সঙ্গে মানুষ। কাড়াকাড়ি চলে। চোখ ফেরাবার উপায় নেই।
এমন অস্থির সময়ে, এক ভরা শ্রাবণে লাবণ্য আর অজিত চক্রবর্তীর মেয়ে জন্ম নিল পৃথিবীতে। ডানা চোখের এক শিশু। বাবা মায়ে নাম রাখল ‘কেয়া। কেয়া চক্রবর্তী।
শৈশব শুরুই হয়েছিল অন্যরকম ভাবে। অজিত- লাবণ্যের ভাঙা দাম্পত্য। মেয়ের বোল ফুটতে শুরু হওয়ার আগেই মা ঘর ছেড়ে বাগবাজারে বাপির বাড়ি। খামখেয়ালি বাবার শাসনে একা একা বড় হয় মেয়ে। তিনতলা ফাঁকা বাড়িতে একা একা ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গী বলতে জ্যাকি। পোষা কুকুর।
মায়ের কাছে যাওয়ার উপায় বিশেষ ছিল না। ছোট্ট কেয়া মায়ের গন্ধটুকুও নাকে পায় না।
একটু বড় হতে স্কুলে ছুটি পড়লে মাসীরা নিয়ে যেত মামাবাড়ি। মায়ের কাছে।
মেধাবী কেয়ার ইচ্ছে ছিল বিলেত যাওয়ার। পড়াশোনার টানে। দেশ বিদেশের বাজনার প্রতি ভালোবাসা। সুবনিয় রায়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত বড্ড প্রিয়। যখন একা একা রাস্তায় হাঁটে, গান গায় কেয়া। সে গান গুনগুনে নয়, বরং উচ্চ কন্ঠে। রাস্তায় ফিরে তাকায় লোক। কিন্তু কেয়া বেখেয়ালে। লোক ভাবে ‘ এ কেমন মেয়ে’!
আসলে সে এমনই। বাঁধা ভাঙা ঝর্ণার মতো তার বয়ে যাওয়া। আকুল শ্রাবণে যেমন করে বৃষ্টি হয়।
অগোছালো কেয়াকে পূর্ণতা দিয়েছিল থিয়েটার। নাটকের মঞ্চ যেন মোহনা দিয়েছিল তাকে। সুবিন্যস্ত হওয়ার চেষ্টা। সুটকেসে শাড়ি এলোমেলো, কিন্তু থিয়েটারের কস্টিউম মেলানোর সময় কোনও ভ্রান্তি নেই।
ব্যক্তিগত জীবনের ঝড়ও স্থির হয়ে যায় সেখানে। মঞ্চের চৌ সীমানায় এলেই কেয়া অন্য মানুষ।
মায়ের পেসমেকার বসবে। যেদিন অপারেশন সেইদিন ‘ভালোমানুষ’ নাটকের ‘ডাবল শো’। দলের মধ্যে চাপা টেনশন। ‘সব সামলে আসতে পারবে তো কেয়া?’
তিনটের সময় শো। ভরে উঠছে রঙ্গনা। ঘড়ির কাঁটায় তখন পৌনে তিনটে, হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন কেয়া। ১০ মিনিটের মধ্যে মেকআপ নিয়ে মঞ্চে। পরপর শো করে পরের দিনের বিজ্ঞাপনেও হাত লাগলেন। ফের ফিরে গেলেন মায়ের কাছে। হাসপাতালে।
নদী নিয়েছিল তাকে। জলের পৃথিবীতে ভেসে যেতে যেতে মঞ্চের আলো মনে পড়েছিল কিনা জানা নেই। সে উত্তর মিশে গিয়েছিল গঙ্গার স্রোতে। তবু তিনি আগুনের নাম। নিজের সময়ের চেয়ে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকা এক মাটির কন্যা। লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ আজও বয়ে চলেছেন আপন স্রোতের উচ্ছাসে...সময় আজও স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে। বিস্মৃতিও না।
ঋণ স্বীকার মধুময় পাল সম্পাদিত আগুনের খেয়া এবং মহালয়া চ্যাটার্জী