মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য, তার জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়েছিলেন পুরী নীলাচলে। দীর্ঘ ২১ বছর তিনি কাটিয়েছিলেন পুরী ধামে। গম্ভীরা গৃহেই প্রভু রয়ে গিয়েছেন দীর্ঘ ১২ বছর। এই সময় মহাপ্রভু দিন রাত নাম কীর্তন ও কৃষ্ণলীলা বিলাসে এমনভাবে আত্মমগ্ন হয়ে থাকতেন, ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যেতেন যে তাঁকে নিয়ে তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদরা প্রায়ই বিপদে পড়তেন। কখনও কৃষ্ণবিলাপ করতে করতে মূর্ছা যেতেন মহাপ্রভু, কখনও আবার জ্ঞান ফিরে পেয়ে মহাপ্রভু পার্ষদদের গলা জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে 'হা কৃষ্ণ' বলে কাঁদতেন। এভাবেই জগন্নাথ ক্ষেত্র পুরীধাম হয়ে উঠেছিল মহাপ্রভুর লীলাক্ষেত্র।
একদিন মধ্যরাত্রি পর্যন্ত মহাপ্রভু কৃষ্ণনাম কীর্তন শুনে কিছুটা শান্ত হয়েছেন। মহাপ্রভুকে শয্যায় শুইয়ে রেখে তাঁর সর্বক্ষণের অনুগত ভক্ত ঘরের বাইরে শুয়ে থাকলেন। ঘরের বাইরে থেকে সেই ভক্ত কান পেতে শুনে চলেছেন প্রভু ঘরের মধ্যে কৃষ্ণনাম করছেন, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাম জপের সংখ্যাও বাড়ছে কিন্তু একসময়ের পর আর ঘরের মধ্যে থেকে কৃষ্ণনাম শোনা গেল না! মহাপ্রভুর কোনও কন্ঠের সাড়া নেই! তবে কি তিনি নিদ্রামগ্ন? নাকি অচেতন হয়ে পড়েছেন? সংশয় জাগে অনুগত ভক্তের মনে!
অনুগত সেই ভক্ত ঘরের বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকেন, তিনি তখন দেখেন পরপর তিনটি দরজা বাইরে থেকে বন্ধ অথচ ঘরে কোথাও মহাপ্রভু নেই! এই গভীর রাতে কোথায় গেলেন মহাপ্রভু? মহাপ্রভুর সন্ধানে তখন দিকে দিকে লোক ছুটে গেল, নিত্য সঙ্গীরা প্রভুকে খুঁজে বের করলেন জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারের উত্তর দিক থেকে। মহাপ্রভু তখন মাটিতে পড়ে আছেন। তাঁর দেহখানি আরও পাঁচ-ছয় হাত দীর্ঘ হয়ে গেছে, নাক দিয়ে নিঃশ্বাস পড়ছে না। মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লাল ফেনা- এই দৃশ্য দেখে ভক্তরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল! কী করবে তারা এখন? কিন্তু অনুগত সেই ভক্ত মহাপ্রভুর কানের কাছে মুখ নিয়ে শোনাতে লাগলেন কৃষ্ণনাম কীর্তন কিছুক্ষণ, এরপর চোখ মেলে তাকালেন মহাপ্রভু , সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল তাঁর স্বাভাবিক আকৃতি। এই ভক্ত প্রবর আর কেউ নন, মহাপ্রভুর অন্তলীলার অন্যতম লীলা সঙ্গী, পরম বৈষ্ণব স্বরূপ দামোদর।
মহাপ্রভুর একনিষ্ঠ সেবক এবং একজন শাস্ত্রজ্ঞ মহাপণ্ডিত হলেন স্বরূপ দামোদর। রাধাভাবে উন্মত্ত শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণপ্রেম বিলাস দেখে তাঁর নয়ন সার্থক হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রতিদিন বিদ্যাপতি, চন্ডীদাসের পদাবলী ও জয়দেবের গীতগোবিন্দের সংগীত পরিবেশন করে প্রভুর কৃষ্ণ বিরহজ্বালা উপশম করে নিজে ধন্য হতেন। যে সকল ভক্তরা মহাপ্রভুকে স্বরচিত শ্লোক ও গান শোনাতে আসতেন তাদেরকে আগে স্বরূপ দামোদরের কাছে ভক্তির পরীক্ষা দিতে হত, স্বরূপ দামোদর অনুমতি না দিলে বা সম্মত না হলে সেই গান কখনই মহাপ্রভু শুনতেন না। আবার মহাপ্রভু নিত্য সংকীর্তনের মাধ্যমে নীলাচলের মধ্যে যে ভক্তি রসের ধারা প্রবাহিত করেছেন তাতে যে সকল ভক্তরা পরিতৃপ্ত হতেন তারা নৃত্যগীতের শেষে স্বরূপ দামোদরের কাছে এসে দাঁড়াতেন মহাপ্রভুর লীলা মাহাত্ম্যের ব্যাখ্যা শোনবার জন্য।
জগন্নাথ মন্দির থেকে রাজপথ, সাগর সৈকত থেকে সর্বত্র যেখানে মহাপ্রভু যেতেন সেখানেই স্বরূপ দামোদর তার সঙ্গে সঙ্গে যেতেন তাঁকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। স্বরূপ দামোদর ছিলেন একদিকে মহাপ্রভুর দেহরক্ষী, মহাপ্রভুর লীলা সঙ্গীত ও তাঁর মর্মবেত্তা।
মহাপ্রভুর লীলা মাহাত্ম্য দেখতে একবার পুরীধামে এসেছিলেন পুন্ডরীক বিদ্যানিধি। বেদবেদান্ত, শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্রে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহের অঙ্গসজ্জায় মাড় যুক্ত নতুন কাপড় ব্যবহার করতে দেখে তিনি বিচলিত হন ও আপত্তি জানান। পুন্ডরীকের আপত্তি দেখে তার বন্ধু স্বরূপ দামোদর তাঁকে বললেন 'জগন্নাথ ধামে সবাই শুদ্ধসত্ত্ব। নিজস্ব নিয়মবিধি অনুসারে দেবতার পুজো হয়। এখানে তোমার আচার বিচারের ব্যাকরণ চালাতে এসো না।' স্বরূপ দামোদরের সতর্কবাণী থাকা সত্ত্বেও পুন্ডরীকের মনের অস্বস্তি দূর হয় না, সেইদিনই রাত্রে জগন্নাথ মহাপ্রভু তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে ক্রদ্ধভাবে তিরস্কার করলেন তাঁর অনধিকার চর্চার জন্য, এবং তাঁকে প্রহারে জর্জরিত করলেন। পরের দিন সকালবেলায় স্বরূপ দামোদর এসে তাঁর বন্ধুর দেহে আঘাতের চিহ্ন দেখে অবাক হলেন এবং পুন্ডরীকের মুখে গতরাত্রের স্বপ্নের কথা শুনে স্বরূপ দামোদর বললেন,'তুমি ধন্য পুন্ডরীক স্বয়ং ভগবানের কৌতুকময় লাঞ্ছনা জুটেছে তোমার শরীরে, তোমার ভাগ্যকে যে কোনও বৈষ্ণব পরম গৌরবের বস্তু বলে মনে করবে।'
সপ্তগ্রামের জমিদার গোবর্ধন দাসের পুত্র রঘুনাথ দাস ৪০ বছর বয়সে সকল প্রতিপত্তি এবং আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করে পুরীধামে এসে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের শরণ প্রার্থনা করেন। মহাপ্রভু তখন ভাবলেন এই সর্বত্যাগী ভক্তের ভার কার উপরে দেবেন? এরপর তিনি স্থির করলেন ভার নেওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হলেন স্বরূপ দামোদর। তখন থেকেই স্বরূপের তত্ত্বাবধানে ও সঙ্গগুণে রঘুনাথ দাসের সাধক জীবনের উন্নতি ঘটতে থাকে তবু রঘুনাথের মনে একটু অতৃপ্তির রেশ রয়ে গিয়েছিল। তিনি সবসময় ভাবতেন মহাপ্রভু কি তাঁকে কোনদিনও উপদেশ দিয়ে ধন্য করবেন না? এই মনের বাসনা নিয়ে একদিন মহাপ্রভু চৈতন্যের কাছে উপস্থিত হলেন রঘুনাথ , উপস্থিত হতেই তাঁকে মহাপ্রভু বললেন, 'আমি যা জানি স্বরূপও তাই জানে' এই কথার পর স্বরূপ দামোদরের সাধন মাহাত্ম্য সম্বন্ধে রঘুনাথের মনে আর কোনও সংশয় রইল না।
মহাপ্রভুর নিকটতম এই পার্ষদ স্বরূপ দামোদর তাঁর কড়চা গ্রন্থের মধ্যে মহাপ্রভুর অন্তলীলার বিবরণ নিয়েছিলেন। স্বরূপ দামোদর লিখিত চৈতন্য জীবনী কাব্য শ্রী চৈতন্য কড়চা আজ বৈষ্ণব সমাজে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ এই লীলা পার্ষদ স্বরূপ দামোদর শেষ সময়েও মহাপ্রভুর সঙ্গে ছিলেন, মহাপ্রভুর আসন্ন জীবন অবসানের ইঙ্গিত স্বরূপ দামোদর অনেক আগেই পেয়েছিলেন, তাই মহাপ্রভুর দেহ রক্ষার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরম ভক্ত স্বরূপ দামোদরের মহাপ্রয়াণ ঘটে।