জন্মের পর ছেলেটিকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, হায় হায়, এই তো জন্মালো! চোখের পলক পড়তে না পড়তেই সে ছেলে গেল কোথায়! মা চন্দ্রমণির বুক অজানা আশঙ্কায় ধড়ফড় করে উঠল। তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন--ও ধনি, কোথায় গেল, কোথায় গেল রে আমার বাছা! বলতে বলতেই চন্দ্রমণি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ধাই ধনি কামারনি সদ্যপ্রসূতি মাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তাই চন্দ্রমণির আর্তচিৎকারে সে প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেল। হুঁশ ফিরতে সেও চেঁচিয়ে উঠল--তাই তো গো, গেল কোথায়! শুরু হল আতিপাতি খোঁজ। সে এক চরম দিশাহারা অবস্থা! আঁতুরঘরটি একে ঢেঁকিশাল, তায় আবার একখানা উনুনও আছে। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ছেলেকে পাওয়া গেল সেই উনুনের মধ্যে। জন্মজলে হড়কে গিয়ে ছেলে ঢুকে পড়েছিল সেই উনুনের ভেতরে। ভাগ্যিস তাতে আগুন ছিল না! শুধু ছিল একরাশ ঠাণ্ডা ছাই। তার মধ্যে পড়ে অদ্ভুত ছেলে বাবা, কান্নাকাটির বালাই টুকুও নেই! বরং ধনি যখন তাকে উনুন থেকে তুলল তখন সে কী রূপ--যেন ছাই মেখে একেবারে শিশু ভোলানাথ! মুখে সদাশিবের মিষ্টি মিষ্টি হাসি।
বাবা ক্ষুদিরাম গয়ায় বিষ্ণুপাদপদ্মে পিণ্ড দিতে গিয়ে স্বয়ং গদাধরকে স্বপ্নে দেখলেন। স্বপ্নে গদাধর তাঁকে বললেন, বাৎসল্য সেবা পেতে পুত্ররূপে আসছেন ঘরে। সেই অদ্ভূত স্বপ্নদর্শনের পর বাড়ি ফিরে শুনলেন স্ত্রী গর্ভবতী! তাঁর মতো স্ত্রীও এদিকে পেয়েছেন দিব্যস্বপ্ন ও দিব্যদর্শন। চন্দ্রমণি একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখলেন, সামনে আবির্ভুত এক দিব্যপুরুষ! অপূর্ব তাঁর রূপ, অপূর্ব তাঁর বেশ! কিন্তু, যেই ঘুমটা ভেঙে গেল, অমনি দেখলেন কেউ কোত্থাও নেই। অবাক হলেন তিনি, ঘর ভেতর থেকে বন্ধ, কে এসেছিলেন ঘরে, কীভাবে এসেছিল! বেশ ভয় পেয়ে পুজো দিতে গেলেন শিবের মন্দিরে, কিন্তু সেখানেও হল দিব্যদর্শন। অলৌকিক জ্যোতিতে ভরে উঠল মন্দির, তারপর সেই জ্যোতি মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে প্রবেশ করল তাঁর গর্ভগৃহে। তিনি ভয়ে জ্ঞান হারালেন।--সব শুনে ক্ষুদিরাম স্ত্রীকে বললেন, এসব কথা যেন পাঁচ কান করো না। এও বুঝলে না, তিনিই যে আসছেন আমাদের ঘরে, আমাদের সন্তান হয়ে!
ক্ষুদিরাম ভগবান গদাধর নারায়ণের কাছ থেকে পুত্ররূপে আসার আশ্বাস পেয়েছিলেন, তাই ছেলের ডাকনাম রাখলেন, 'গদাধর'। তাঁর বড় দুই ছেলের নাম--রামকুমার আর রামেশ্বর। তাঁদের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের ভালো নাম রাখলেন, 'রামকৃষ্ণ'।
উনিশ শতকে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান মিশনারীদের সমবেত ধর্মের ঢাক পেটানোর যুগে বাঙালিকে মুক্তি দিতে রামকৃষ্ণ নতুন কোন ধর্মমতের প্রচার করেননি। বরং, হিন্দুধর্মের ঔদার্যে শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব-গাণপত্য-সৌরকে এক ঘাটে মিলিয়ে ইসলাম আর ইশাপথের সাধনাকেও একসূত্রে বেঁধেছিলেন, হয়েছিলেন, 'পরমহংস'। 'যত মত তত পথ'-মন্ত্র দিয়ে বাঙালিকে শিখিয়েছিলেন পরধর্ম সহিষ্ণুতার সাধন। বাঙালির ধর্মীয় নবজাগরণে তাই তিনি যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক।