কোচবিহারের ফালাকাটার একটা অঞ্চল। গভীর অমাবস্যার রাতের একটি ঘটনা। ওই অঞ্চলে মানুষ মাঝে মাঝেই একটা বাঁশঝাড়ের ভেতর অদ্ভুত কিছু শব্দ শুনতে পেত। সন্ধ্যের পর অন্ধকারে ওই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতের সময় খসখসে একটা শব্দ শোনা যেত। খুব সাহসী কিছু ব্যক্তিরা ওই অঞ্চলে সরাসরি সময়টায় উপস্থিত থেকেও শুধু শব্দই শুনতে পেয়েছেন। কাউকে দেখতে পাননি। তবে অনেকেই অনুভব করতে পেরেছেন একটা তীক্ষ্ণ অস্তিত্ব। ভয়ে জড়সড় হয়ে গুটিয়ে বসে থাকতেন অনেকে। হঠাৎ করে ওই অঞ্চলটি দিয়ে যাতায়াতের সময় এমন কিছু শব্দ শুনে অনেকে উল্টো পথ ধরেছেন। স্থানীয় মানুষরা একসময় ঠিক করলেন কোন একজন দেবতাকে তুষ্ট করে এই অলৌকিক শক্তির থেকে মুক্তি পেতে হবে । এভাবেই জন্ম হয় ঢেল ঠাকুরের। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দুই দিনাজপুর, মালদা, এমনকী সুদূর বাংলাদেশ এবং আসামেও একজন এরকম অদ্ভুত দেবতার পুজোর প্রচলন রয়েছে। এই দেবতার নাম ঢেল ঠাকুর। এই ঠাকুরের কোন মূর্তি নেই। থান বলতে রাস্তার ধারের কোন বট, পাকুড় কিংবা কুল গাছকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুজো, পালা বা পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়।
শোনা যায় রাস্তাঘাটে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে কিংবা বিপদ-আপদ হলে এই ঠাকুর রক্ষা করেন। আগে মানুষ যখন ভয় পেয়ে গুটিসুটি মেরে উল্টোদিকে পালিয়ে যেত তখন তার সব অপূর্ণ ইচ্ছে, ভয়, শংকাকে একটা পোটলা বেঁধে ছুড়ে দিত কোন বট, পাকুড় বা কুল গাছের উদ্দেশে। অদ্ভুতভাবে তাদের মনে হতো আর ভয় করছে না। ভয় থেকে মুক্তি পেতেন। ঢিল ছুড়ে মারার মত করে পুজো করা হতো বলে এই ঠাকুরের নাম ঢেল ঠাকুর বলা হয়। অনেকে শুকনো খড়কুটো, ঘাস, পাথর একসঙ্গে পোটলা করে জড়ো করে গাছের দিকে ছুড়ে মারেন। শুধু গাছ হিসেবেই এই ঠাকুরকে কল্পনা করা হয় না। কোথাও গাছের নীচে মাটির ঢিবি কিংবা পাথরের টুকরোকেও ঢেল ঠাকুর হিসেবে কল্পনা করা হয়ে থাকে।
যেমন দিনহাটার গোসানিমারি রোডের শকুন্তলা স্টপেজের ওখানে একটা গাছকে ঠাকুর মেনে ঢিল ছোড়া হয়, এদিকে আমবাড়ি চৌপথিতে একটা কুল গাছকে ঢেল ঠাকুরের থান হিসেবে মানা হয়। উচলপুকুরী গ্রামে ঢেল ঠাকুরের থান রয়েছে একটা গাছের সামনে। সেখানে বাঁশ পুঁতে ঢেল ঠাকুরের পুজো করা হয়।
ফালাকাটার ধনীরামপুর গ্রামে বহু পুরনো বট গাছকে ঠাকুর হিসেবে পূজা করা হয়। শুকনো ঘাস, খড়কুটো তুলে পোটলা বেঁধে জুড়ে ভক্তি জানানো হতো ঠাকুরকে। আগে নাকি এখানে হোলির সময় মেলা বসত। ঢেল ঠাকুরের পুজো বলতে মূলত মানত করার বিশেষ পদ্ধতি। যে যার মত করে পুজো করেন।
মালদা এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে ঢেল ঠাকুরের নাম পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে ঢিল ছোড়ার রীতিও। এখানে ঢিল ঠাকুর সোনিয়া পীর, ভক্তি পীর হিসেবে পরিচিত। থানে ছেঁড়া কাপড় উৎসর্গ করে ভক্তি জানানো হয় বলে এই ঠাকুরের নাম এখানে ধকর পীর। মালদহে ছেঁড়া ন্যাকড়া উৎসর্গ করে ঠাকুরকে ভক্তি জানানো হয় বলে এই পীরকে বলা হয় নেড়ো পীর। এভাবেই ঢেল ঠাকুরের নাম এবং তার অস্তিত্ব উত্তরবঙ্গ জুড়ে সবুজ গাছ-গাছালির মতোই ছড়িয়ে রয়েছে।