বহুকাল আগের কথা। কালসুর নামে এক অসুর ছিল। মহাদেবের আশীর্বাদপ্রাপ্ত এই অসুর ধর্ম রক্ষার কথা বলতেন। তিনি কখনো অধর্ম হতে পারে এমন কোন কাজ করতেন না। তিনি কারো অনিষ্ট করার কথাও চিন্তা করতেন না। স্বয়ং ভগবান শিব কালসুরের মধ্যে এত গুণ দেখে তাঁকে বরদান করেন যে অসুর হলেও তাঁর এই দেবতুল্য মনের জন্য তিনি মর্ত্যে পুজো পাবেন। কথিত আছে তখন থেকেই নাকি পৃথিবীতে কালসুরের পুজোর প্রচলন শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গে এই কালসুরের মূলত দুটো থান রয়েছে। একটা থান কোচবিহার জেলার রসিকবিলের পাগলী কুঠিতে। আরেকটা থান আছে আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়ির আদি মা কামাখ্যা ধামে। এই আদি মা কামাখ্যা ধামটি স্থাপন করেছিলেন সেই সময় কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। এই ধামে মা কামাখ্যার পাশাপাশি আরও আঠারোজন দেবতা এবং উপদেবতার পুজোর প্রচলন রয়েছে।
কালসুরকে দেবতা হিসেবে পুজো করা শুরু করেছিলেন মূলত রাভা সম্প্রদায়ের মানুষরা। আষাঢ় মাসের ১১ তারিখে মা কামাখ্যা ধামে কালসুরের পুজোর প্রচলন শুরু হয়েছিল অন্যান্য দেবদেবীদের সঙ্গে। সাধারণত ওই সময়ই অম্বুবাচী পড়ে। অম্বুবাচী তিথিকে মাথায় রেখে এই গ্রামে এই পুজো হয়। পুজোর আগে ১০ থেকে ১৫ ইঞ্চির সরু সরু লম্বা বাঁশ নিয়ে সেগুলিকে লাল শালু কাপড়ে জড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর বাঁশের মাথায় লাগানো হয় ত্রিশূল আর চ্যাঙোড়। মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে মন্ত্র পড়ে বাঁশ জাগান গান গাওয়া হয়। তারপর এই বাঁশগুলোকে নিয়ে প্রত্যেক দেব-দেবীর স্থানের সামনে পুঁতে রাখা হয়। পুজোর পাঁচ দিন আগে সেই বাঁশগুলোকে নিয়ে ভক্তরা আশেপাশের বাড়ি ঘর ও হাটবাজারে মাগন সংগ্রহ করে। বাজনার তালে তালে একটি নির্দিষ্ট নাচ নেচেই ওরা মাগন সংগ্রহ করে আনে।
কালসুর হল বিনাশ বা ধ্বংসের দেবতা। কেউ অন্যায় করলে কালসুর ভারি অসন্তুষ্ট হন। তারপর তিনি তাঁকে আক্রমণ করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কালসুর ভর করলে সেই আক্রান্ত ব্যক্তির রাগ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। রাগ বেড়ে যাওয়ার ফলে তার স্বাভাবিক ব্যবহারে পরিবর্তন দেখা যায়। এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে কালসুর দেবতার থানে নিয়ে যাওয়া হয়। থানের পূজারী কালসুরের মন্ত্র পড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিম পাতা দিয়ে ঝাড়ফুঁক করে নাকি বিষমুক্ত করে। কোচবিহার জেলার রসিকবিলের পাগলী কুঠিতে যে কালসুরের থান রয়েছে সেখানে আবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে নতুন গামছা দিয়ে মাথা থেকে পা অব্দি মন্ত্র পড়ে ঝেড়ে দেওয়ার জল রয়েছে। কালসুরের পুজোয় দুধ, কলা এবং দই প্রয়োজন হয়।
মধ্য কামাখ্যাগুড়িতে কালসুরের মূর্তি পূজোর প্রচলন রয়েছে। লম্বা চুল, দুই হাত, এক হাতে অস্ত্র খালি গা, পরনে লম্বা ধুতি এমনই দেখতে কালসুরকে। মাটির মূর্তিটি প্রতি বছর নতুন করে তৈরি করা হয়।
কোচবিহার জেলার রসিকবিলের পাগলীকুঠিতে কালসুরের থানে একদিনই পুজো হয়। সেটা হল মাঘ মাসের ১৫ তারিখ। এর আগে সাত দিন ধরে নিত্য পুজো চলে। প্রথমে ১০ থেকে ১৫ ইঞ্চির লম্বা লম্বা বাঁশ লাল শালুতে জড়িয়ে মন্ত্র পড়ে সেই বাঁশগুলোকে জাগিয়ে বাঁশজাগানি গান গাওয়া হয়। এরপর মাগন তোলার পদ্ধতিটি একই। তবে রসিক বিলের পাগলীকুঠিতে এই পুজোর উপকরণ একটু বেশি। যেমন দই, চিঁড়ে, গুড়, আটিয়া কলা, ফলমূল, লাল নিশান, প্রদীপ আর বিশেষ করে লাল ফুল। পাগলী কুঠিতে কালসুরের মূর্তিটা কালো রঙের, দেখতেও ভয়ংকর। তৃতীয় মাটির মূর্তির খালি গা, গলায় অলংকার এবং হাঁটু অবধি কোঁচানো ধুতি। বাৎসরিক পুজো ছাড়াও অন্যান্য তিথি যেমন পূর্ণিমা, অমাবস্যা কিংবা শুভ কোনদিনেও এখানকার থানে পাঁচ রকম ফল আর দুধ দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়।
লোক বিশ্বাস এবং সাধারণ জীবন যাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এইসব লৌকিক দেবতাদের আরাধনা।