একটা কদম গাছের তলায় একসময় এক বুড়ি থাকতেন। উত্তরবঙ্গের উচলপুকুরির কথা। শোনা যায় গ্রামে একবার কলেরা এসে আছড়ে পড়ে। কলেরার প্রকোপে অনেক মানুষ মারা যান। এই কলেরায় এক বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন পড়েছিলেন। তাঁর কোন চিকিৎসাও হয়নি। এদিকে কলেরার প্রকোপে গ্রামের মানুষ যখন মারা যাচ্ছেন সেই বয়স্ক মহিলাকে আলাদা করে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়। এটি কদমগাছের তলায় আশ্রয় নেন। কয়েকদিন পরে মৃত্যু হয় তাঁর। এইভাবে একঘরে করে দেওয়ার জন্য নাকি তিনি গ্রামের মানুষের উপর রুষ্ট হন। পরবর্তীকালে এই লৌকিক ইতিহাস থেকেই সৃষ্টি হয় কদমতলী নামের এক অপদেবতার। তাঁকে পুজো করা হয় উচলপুকুরী গ্রামে। সেখান থেকেই এই ঠাকুরের উদ্ভব হয়েছে।
কোচবিহারের উচলপুকুরী গ্রামের এক স্থানীয় মানুষ আমছাড়উদ্দিনকে ঘিরে প্রথম লোকশ্রুতিটি শোনা যায়। একটি কদমফুলের গাছের নীচে থাকা জমিতে একটা বাড়ি করতে গিয়েছিলেন স্থানীয় এক মানুষ আমছাড়উদ্দিন। কদম গাছের তলাতেই নাকি থাকতেন কদমতলী ঠাকুর। লৌকিক অপদেবতা। অনেকেই আমছাড়উদ্দিনকে সাবধান করেছিলেন ওখানে অন্তত কোন বাড়ি না করার জন্য। তিনি শোনেননি।
শোনা যায় কদম গাছটি কেটে আমছাড়উদ্দিনের মিস্ত্রীরা সেখানে কাজ শুরু করেছিলেন। একটা পাকা, বাঁধানো মেঝেতেই রাত্রিবেলা শুয়ে ঘুমাচ্ছিলেন ওই মিস্ত্রীরা, পরের দিন তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায় ওখান থেকে।
এর পরেই আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। ওখানে আরেকটি কদমগাছের জন্ম হয়েছে। এরপর ওখানে কদমতলী ঠাকুরের ধান তৈরি করে লৌকিক অপদেবতা হিসেবে পুজো শুরু হয়। কদমতলীর পুজোর কোন নির্দিষ্ট তারিখ বা দিনক্ষণ নেই। ভক্তরা পুজো দিতে বাড়ি থেকে দই ,চিঁড়ে নিয়ে যায় ঠাকুরের উদ্দেশে। পুজোর পর ৩-৪ বালতি দই চিঁড়ার প্রসাদ দেওয়া হত এক সময়।
খুব সামান্য কিছু উপকরণ দিয়ে পুজো শুরু হয়। দুধ, কলা, চিনি দই, নানান ফল, কলার ঝুঁকি ও ঘট। আগেকার দিনে কদম গাছের গোড়ায় আসন পেতে বসে পূজারী এইসব উপকরণ দিয়ে কদমতলীর পুজো করতেন। এখন যেখানে থান রয়েছে এইভাবে পুজো আর হয় না। কেউ মানত করলে তবেই পুজো হয়।
স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কদমতলীর কোপ যার উপর পড়ে সে নাকি আর বাঁচে না। আগে বলা হত কদমতলীর থানের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় গুনগুন করে গান করলে বা চিৎকার করে আওয়াজ করলে ঠাকুর নাকি তার উপর ভর করেন। সেই ব্যক্তি তখন কলেরায় আক্রান্ত হয়। একবার আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তি কদমতলী ঠাকুরের থানে পৌঁছে যান। ঠাকুরের থানে নিজেকে তিনি উৎসর্গ করেন। শোনা যায় এই লৌকিক বিশ্বাস দীর্ঘদিন ওই গ্রামে সঙ্গ দিত। পরবর্তীকালে এই বিশ্বাস পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও ওইখানে এখনো ব্যতিক্রমী লৌকিক অপদেবতা হিসেবেই কদমতলী পুজিত হন।
আগেকার দিনে ডায়রিয়া বা কলেরা হলে যেভাবে পাড়াগাঁয়ের লোকেরা রোগীকে এক ঘরে করে রাখতেন তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগে কেউ মারা গেলে তার সৎকার হত না। পরবর্তীকালে স্থানীয়দের মধ্যে সেই ব্যক্তিকে ঘিরে নানা জনশ্রুতি প্রচলিত হতে থাকে। সেখান থেকেই এমন অতিপ্রাকৃত লৌকিক দেবীর জন্ম। আধুনিক চিন্তা-ভাবনার বাইরে এ যেন অন্য এক টুকরো বিশ্বাসের দুনিয়া।