দেবী দুর্গারূপী এই ঈশ্বরীর পায়ের কাছে অসুরের সঙ্গে থাকেন বাঘ, সিংহ আর মহিষ

উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়ি থেকে ভোটপোট্টি হয়ে হেলাপাকরির রাস্তায় কিছুটা আগে একটা মোড় আছে যাকে বলে জল ট্যাঙ্কি। এই জল ট্যাঙ্কি পেরিয়ে যেতে হয় খয়ের খাল গ্রামে। ‌ খয়ের খাল ময়নাগুড়ির এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে অবস্থিত। এই গ্রামে রয়েছে একটি আশ্চর্য বিল। এই বিল এবং তার আশেপাশে থাকা লৌকিক দেবতাদের ঘিরে রয়েছে অনেক গল্প। এই বিলটার ওপরে পুরো সবুজ ঘাসের আস্তরণ। তার ওপর দুটো পানসিপ্টি গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে ঘাসের পুরু জলা জমি দেখা যায়। জলের ভেতর গিজগিজ করছে মাছ। ঘাসের আস্তরণ এতটাই মোটা যে তার উপর দিয়ে নাকি হেঁটে চলা যায়। এই স্থানীয় জায়গাটাকে বলে থান। স্পষ্ট করে বললে, মা গোসানীর থান। একবার সরকার থেকে এই ঘাসের আস্তরণ সরিয়ে মাছ চাষের কথা ভাবা হয়েছিল। অদ্ভুতভাবে দেখা যায় যে এই পুরু ঘাসের আস্তরণ সরিয়ে জলের অংশে মাছ চাষের পরিকল্পনা শুরু হচ্ছে আবার পরের দিন এখানে ঘাস গজিয়ে উঠছে। 

শোনা যায় এই অঞ্চলে সবচেয়ে জাগ্রত দেবী মা গোসানী। কথিত আছে স্থানীয় জনৈক রাজবংশী মাড়েয়া একবার স্বপ্নে একটি সোনার দেবী মূর্তি দেখেছিলেন। স্থানীয় সেই মাড়েয়াকে দেবী নাকি আদেশ দিয়েছিলেন যে বিল থেকে তুলে এনে যেন তাঁর পুজো করা হয়। এমনকী সেই মাড়েয়াকে দেবী নিজের নাম গোসানী মা বলে উল্লেখ করেন।। তারপর দিন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে। সেই মাড়েয়া ব্যক্তিটি ওই বিলের কাছে গিয়ে দেখেন বিল থেকে একটা ছোট্ট নয় ইঞ্চি মাপের সোনার দুর্গামূর্তি ভেসে উঠেছে। দেবী দুর্গার রূপ হলেও এই মূর্তির পায়ের কাছে রয়েছে অসুর যাকে দুপাশে দুহাত দিয়ে কামড়ে রয়েছে বাঘ আর সিংহ। সঙ্গে রয়েছে মহিষের মাথা ‌। মাড়েয়া ব্যক্তিটি মূর্তিটিকে পরম যত্নে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। রূপোর সিংহাসন তৈরী করা হয়। পরবর্তীকালে ২০০২ সালে মন্দিরটি সংস্কার করে নতুন করে তৈরী করা হয়। এই গ্রামের আরেক লৌকিক দেবী বিল পাগলীর বোন নাকি এই মা গোসানী। 

মা গোসানীর পুজো হয় দুর্গাপুজোর নবমীর দিন। এই একদিনই পুজো হয় এখানে। পুজো করেন রাজবংশী মাড়েয়ারাই। মা গোসানীর মূর্তি মন্দিরে থাকে না। মূর্তি থাকে মাড়েয়া রাজবংশী ব্যক্তিটির বাড়িতে। নবমীর দিন পুজোর সময় দেবী মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুজোর পর সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই আবার ঘটের মধ্যে জল ঢেলে ওই জলের মধ্যে মা গোসানীর মূর্তিকে প্রতিকী বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর সেই মূর্তিটি দেখে আসা হয় সেই মাড়েয়া ব্যক্তিটির বাড়িতে। এই পুজোয় মূলত পায়রা আর পাঁঠাবলি দেওয়া হত মানত অনুসারে। নবমীর দিন মা গোসানীর সঙ্গে একই সঙ্গে পূজিত হন কেচক ও কেচকানি। 

মা গোসানীকে স্থানীয়রা মা গোসানী বুড়িও বলে থাকেন। পশ্চিমবাংলায় এই বুড়ি নামে একাধিক জেলায় পুজো হয়। বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খন্ড, দুর্গাপুর, আসানসোল, এমন বুড়ির পুজোর থান রয়েছে। বেশিরভাগ বুড়ির থানগুলোতে মূর্তি পূজার প্রচলন নেই। ফাঁকা জমির মধ্যে সিমেন্ট বাঁধাই করে চৌকো জায়গা করে এখনো পাথরকেই বুড়ি কল্পনা করে পূজা করা হয়। বুড়ির থানে স্তুপ করে পোড়া মাটির ঘোড়া, হাতির মূর্তি পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকে মনে করেন মা গোসানী খয়ের খাল গ্রামের রক্ষাকর্তা। তাই তাকে এই প্রাচীন অভিধাটি দেওয়ার জন্য বুড়ি নামে ডাকা হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...