একটা সবুজ রঙের মাঠ। অনন্ত পথের যাত্রী হিসেবে সেই মাঠে জেগে রয়েছে কয়েক টুকরো পাথর। সেই পাথরখন্ডে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে পুজো করা হয়। লৌকিক এই দেবতা নিরাকার। তবুও সকলেই ভক্তি করেন। নিজেদের মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য দেবতার কাছে আর্জি জানান। এই দেবতা আসলে অন্য এক দেবতার সঙ্গী।
কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জের উচলপুকুরী গ্রাম। এই গ্রামে উচলপুকুরী ঠাকুরের থান রয়েছে। এই নিয়ে কথিত রয়েছে একটি লোকশ্রুতি। এক অমাবস্যার রাতে উচলপুকুরী গ্রামের পূর্বদিকে রাস্তা ধরে একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে এগিয়ে এসেছিলেন এক যুবক। অলংকারে সুসজ্জিত, রাজবেশে সেজে ওঠা সেই যুবক নাকি এক দেবতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সেই দেবতার নাম নাকি বুড়িজান।
উচলপুকুরী গ্রামে এই লোককথাটি বহুদিন ধরে প্রচলিত। উচলপুকুরী গ্রামের দেবতা উচলপুকুরী ঠাকুর নাকি এই বুড়িজানের সঙ্গে দেখা করতে অমাবস্যায় আসেন।
উচলপুকুরী ঠাকুরের মূর্তিটা রাজবেশে একটা সাদা ঘোড়ার ওপর বসে থাকেন। এই গ্রামের পূর্বদিকে দেড় কিলোমিটার গেলে দামের বাসা পার করেই ডাঙ্গা অংশ পড়ে। সামনে দিয়ে বয়ে গেছে জলসূয়া নদী। এই নদীর পাশেই একসময় একটি বাঁশঝাড় ছিল। আর সঙ্গে ছিল একটা বিশাল পাকুড় গাছ। শোনা যায় সেই পাকুড় গাছের নিচে কয়েকটা পাথরখন্ড ছিল যা এখনো রয়েছে। তবে পাকুড়গাছটা নষ্ট হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে রয়েছে বটগাছ। এই পাথর খণ্ডে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে প্রতিকী ঈশ্বর হিসেবে বুড়িজান ঠাকুরের পুজো করা হয়।।
একেবারে লৌকিক এই দেবতা নারী নাকি পুরুষ তা নিয়ে কেউ সঠিকভাবে কিছু জানে না। তবে গ্রামের সবাই শ্রদ্ধা ভক্তি নিয়ে এই বুড়িজান ঠাকুরের পূজা করেন। মূলত স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পুজো করেন। এখানকার স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী গ্রামদেবতা উচলপুকুরী ঠাকুর নাকি অমাবস্যা আর পূর্ণিমার রাতে কখনো বা কাক ডাকা ভোরে ঘোড়ায় চড়ে বুড়িজান ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। শোনা যায় এই দিনগুলোয় স্থানীয় অনেকেই নাকি ভোররাতে ঘোড়ার পায়ের শব্দ পান। তবে বুড়িজান ঠাকুরের সঙ্গে এই উচলপুকুরী ঠাকুরের সম্পর্কের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না।
বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহে বুড়িজান ঠাকুরের পুজো করা হয়। এই পুজো উপলক্ষে ঢাকঢোল আনা হয়। ভক্তি ভরে চলে পুজোর আড়ম্বর। অনেকে বলেন বুড়িজান ঠাকুর স্থানীয় মানুষদের ওপর ভর করে। বুড়িজান ঠাকুরকে দই চিড়ে দিয়ে পুজো দেওয়া হয়।
তবে এই অঞ্চলে বহুকাল থেকে বুড়িজানের পুজো হয়ে আসছে। এই পুজোয় কোন দেউসী থাকে না। যে যার নিজের মত মানত করে পুজো দেয়। এই পুজোয় কোন মন্ত্র পাঠের চলও নেই। পুজোর উপকরণ হিসেবে দই চিঁড়ে, ফলমূল , ফুল, গাঁজা লাল নিশান কলার কাঁদি দেওয়া হয়।। এমনকী এখানে কোন বলিপ্রথাও নেই। পাঁঠা বা পায়রা মানত করার চলও নেই। বুড়িজানের থানে বাৎসরিক পুজো বাদ দিলে কোন নিত্য পুজো হয় না। বুড়িজানকে পুজো দেওয়ার সময় জল ও সোয়াপীর কদমতলী আর বুড়িজানেরনাম নিয়ে পুজো দিতে হয়।