পাহাড়ী জঙ্গলে বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য জন্ম হয় বাঘসুরের

উত্তরবঙ্গের ব্যাঘ্র দেবতা বাঘসুর। এই দেবতার পুজো করা শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে। উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গায় ছিল একসময় পাহাড়ে ঘেরা এবং জঙ্গলময়। বিষাক্ত পোকামাকড়, হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের প্রকোপ ছিল প্রবল। সেইসঙ্গে বাঘের উপদ্রব উল্লেখযোগ্য ছিল। বাঘের কবলে পড়ে বহু স্থানীয় মানুষ মারা গিয়েছিল। সেই থেকে জন্ম নেয় অলৌকিক বিশ্বাস।

লৌকিক দেবতা জন্ম নেওয়ার পেছনে গড়ে ওঠে যে অলৌকিক বিশ্বাস তা হল বাঘের অধিষ্ঠাতা কোন দেবতাকে পুজো করে সন্তুষ্ট করতে পারলে বাঘের আক্রমণের প্রকোপ কমবে। এই বিশ্বাস থেকেই বাঘসুর দেবতার পুজোর প্রচলন হয়। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার রসিক বিলের টাকোয়ামারির পাগলীকুঠিতে স্থানীয় রাভা সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রথম বাঘসুরবাবার পুজোর প্রচলন শুরু করে।

টিনের ছাউনি দিয়ে ঘেরা একটি জায়গায় পুজো করা হয় এই দেবতার। বাঘের পিঠে বসে থাকা দেবতা পুজো নেন ভক্তদের। বাঘসুরবাবার বাৎসরিক পুজো হয় মাঘ মাসের ১৫ তারিখ। কথিত আছে দেবী পাগলী মা নাকি স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন সেই সময়কার এক দেউসীকে। তিনি মাঘ মাসের ১৫ তারিখ পুজো করার নির্দেশ দেন। ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর মাঘ মাসের ১৫ তারিখ করে পাগলী মা, ভটোমুনি ও বাঘসুরের পুজো শুরু হয়।

এই বাঘসুরবাবার থানে আগে কালী মূর্তি ও পাগলি মূর্তির পুজো করা হত। বাঘসুর ও ভটমুনির পুজো হতো ঘট স্থাপন করে। পরবর্তীতে মূর্তি তৈরি করে পুজোর প্রচলন শুরু হয়। মূর্তিটি অলংকারে সুসজ্জিত, রাজবেশ পরিধান করে থাকেন দেবতা, বাঘের ওপর আসীন। দেবতার সঙ্গে বাঘেরও পুজো করা হয়। মূর্তি পুজোর পাশাপাশি বাঘসুরের প্রতিকী বাঁশ স্থাপন করেও পুজো করা হয়। এই প্রতীকী বাঁশগুলোকে নিয়ে বাঁশ জাগানি গান হাওয়া হয়। পুজোর সময় ঘট স্থাপন করা হয়। ঘটে থাকে দুধ, ঘাটের জল, পান সুপারি। পাঁচ রকম ফল ও কাঁচা কলার কাঁদি দেওয়া হয় পুজোর ফল হিসেবে। দই, চিঁড়ে, গুড়, পাঁচটা ফল হিসেবে দেওয়া হয়। পাগলী কুঠির থানে পূজারী দেউসী পুষ্পেন রাভা। শোনা যায় এই পুজোয় নাকি ভর হয়। যাঁর ওপর ভর হয় তিনি জোরে জোরে গর্জন করেন এবং বাঘের ভঙ্গিতে চলাফেরা করেন। এই পুজোয় দেবতার উদ্দেশে হাঁস বলি দেওয়ার রীতি আছে। পুজোর পর ভক্তদের খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়।

আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়ির আদি মা কামাখ্যা থানেও বাঘসুরের মূর্তি পুজোর প্রচলন আছে। মধ্য কামাখ্যাগুড়ির বাঘসুরের মূর্তি কিছুটা আলাদা। এখানে এই ঠাকুরের মাথাটা বাঘের আর শরীরটা মানুষের। হাতে একটা লাঠি ধরা। অন্য হাতে আশীর্বাদ করে ভক্তদের। মধ্য কামাখ্যাগুড়ির আদি মা কামাখ্যা ধামে প্রতিবছর আষাঢ় মাসের ১১ তারিখে মা কামাখ্যা এবং অন্যান্য লৌকিক দেবতা উপদেবতাদের পাশাপাশি বাঘসুরের বাৎসরিক পুজো করা হয়।। এখানে এই বাঘসুরের ঠাকুরের উদ্দেশে একটা হাঁসকে উল্টো দিক দিয়ে বলি দেওয়া হয়। পূজোর উপকরণ কোচবিহারের বাঘসুর পুজোর মতই। তবে এখানে বাৎসরিক পূজোর পাশাপাশি নৃত্য পুজোর জলও রয়েছে। কোচবিহার আলিপুরদুয়ার জেলার স্থানীয় রাজবংশী এবং রাভা সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই বাঘসুর দেবতার পূজা করে।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...