উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ভগবান শিব পূজিত হন নানা লৌকিক রূপে। যেমন একটি অঞ্চলে শিব ঠাকুরের অপর নাম ‘বুড়া চৌপারী’। কোথাও তিনি ‘গেরাম ঠাকুর’। এই দুই ক্ষেত্রেই পুজোর রীতিনীতিও আলাদা। এমনকি উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ সমাজে মহাকাল, মাসান, মদনকাম, জটা, বুড়া ঠাকুর, গরিমা ধুম বাবা, ধুলিয়া ঠাকুর হিসেবেও শিবলিঙ্গের পুজোর প্রচলন রয়েছে।। শিব ঠাকুর কোথাও মদন কাম কোথাও আবার ভূতো বাবা। শিব ঠাকুরের এই ব্যতিক্রমী লৌকিক রূপ নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে আরেক লৌকিক দেবতার নাম উঠে আসে। তিনি ভাঙি ঠাকুর। এই ভাঙ্গি ঠাকুর উত্তরবঙ্গে পূজিত শিবের আরেক ব্যতিক্রমী লৌকিক রূপ।
কোচবিহার থেকে মাথাভাঙা হয়ে শিলিগুড়ি যেতে গেলে মাথাভাঙা পার করে কিছুটা গেলেই জামালদহ নামে একটা জায়গা পড়ে। সেখান থেকে আরও কিছুটা এগোলে গোপালহাট কালিবাড়ি এলাকা। বাস থেকে নেমে টোটো করে যেতে হয় বাকি পথ।
ভাঙির কোট বলে একটি বিশেষ জায়গায় রয়েছে ভাঙি ঠাকুরের থান। এটি মূলত জঙ্গুলে এলাকা। শাল, সেগুন, গামারী, আম, পেয়ারা গাছের জঙ্গল রয়েছে। এখানে খুব বেশি হিংস্র জন্তু জানোয়ার না থাকলেও রয়েছে বিষাক্ত সাপের উপদ্রব। ভাঙি ঠাকুরের নাম থেকে জায়গাটার নাম হয়েছে ভাঙির কোট। এই বিষাক্ত সাপের উপদ্রব থেকে ভগবান শিব স্থানীয় মানুষকে রক্ষা করেন এই বিশ্বাস থেকেই ভাঙি ঠাকুরের জন্ম। তবে এরা ভাঙি ঠাকুরকে শিব জ্ঞানেই পুজো করেন।
প্রত্যেক বছর শিবচতুর্দশীর দিন ভাঙির কোটের এই থানে ভাঙি ঠাকুরের পূজা করা হয়। এই থান নাকি বহু প্রাচীন। আগে পাথর কে আগে ভাঙ্গি ঠাকুরের প্রতীক হিসেবে পুজো করা হতো। গত ১০ বছর ধরে প্রতীকী পাথর খন্ডের বদলে মূর্তি পূজার প্রচলন শুরু হয়েছে। পুজো করেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। মাড়েয়া হিসেবে থাকেন রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোক।
বর্তমানে একটি শিব ঠাকুরের মূর্তিকেই ভাঙি ঠাকুর হিসেবে পুজো করা হয়। তাঁর গলায় রয়েছে রুদ্রাক্ষের মালা। জটাধারী। ঠাকুরের মূর্তিটা একহাতে আশীর্বাদ করেন। ভাঙি ঠাকুরের মূর্তিটা একটা সাদা ঘোড়ার ওপর বসে থাকেন। মূর্তির দুপাশে দুদিকে মুখ করা দুটো সিংহের মূর্তি। ভাঙি ঠাকুরের বিশেষত্ব এটাই যে, এখানে শিবের বাহন ঘোড়া। প্রত্যেক বছর পুজো শুরুর আগে আগের বছরের মূর্তিটা বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো করা হয়।
প্রতি বছরে মূর্তি তৈরি করেন ওই অঞ্চলের বর্মন পরিবারের সদস্য। পুজোর উপকরণ খুব সামান্য। মোয়া, দই, চিড়ে, দুধ কলা, ফলমূল নকুল দানা ও বাতাসা। ভাঙি ঠাকুরের পুজোয়ে গাঁজা দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। পুজোর পর ভক্তরা প্রসাদ হিসেবে খিচুড়ি আর পায়েস পায়। যাঁরা ঠাকুরের পূজোয় মানত করেন তাঁরা পাঁঠা কিংবা পায়রা ঠাকুরের থানে দেন। এখানে কোন বলি প্রথা নেই। ঠাকুরের সামনে পায়রা এবং পাঠাগুলোকে উৎসর্গ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই দেবতার থানে দুধ, খই, চিড়ে, মুড়ি বাতাসা দিয়ে মানত করে পুজো দেওয়া হয়।
শিবচতুর্দশী উপলক্ষে ভাঙির কোটের এই থানে একদিন মেলা বসে। সারাদিন মেলা চলে তারপর সন্ধ্যেবেলা মেলা গুটিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরে। মেলা ঘিরে দোকানপাট বসে। পানের দোকান, মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান সব মিলিয়ে শিবের এই ব্যতিক্রমী রূপ ভাঙি ঠাকুর জাঁকজমক করেই উত্তরবঙ্গে পূজিত হন।