মহাকাল ভৈরবের অনুচর অপদেবতা নিশাচরের কথা

বাংলাদেশের জামিরতায় একটি লোকশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। জামিরতা শান্ত গ্রাম। নদীর তীরে বয়ে চলা এক স্রোতহীন গ্রাম। এই নদীর কাছেই রয়েছে পাগলনাথের মন্দির। এই মন্দিরের পাশের রাস্তা দিয়ে এক বাবা ও ছেলে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ করে ছেলেটির চোখে পড়ে একটি বীভৎস দৃশ্য। অন্ধকারে একটা অবয়ব গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসছে ওঁদের দিকে। শরীরবিহীন একটা মুন্ডু। ছেলেটি বাবাকে অবয়বের দিকে ডেকে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে যায়। বাবা তখন মুখ চেপে ধরে ছেলেটির। 'চুপ, চুপ জানিসনে, ওঁর আসল নাম মুখে নিতে নেই! ও হচ্ছে নিশাচর।''

বাংলাদেশের বেড়া থানার নাকালিয়ায় অপদেবতা হিসেবে পুজিত হতেন এই নিশাচর ঠাকুর। এই ঠাকুরের মাথা নেই। কাঁধ নেই বলে তার আরেক নাম নিকুন্দা। তবে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই ঠাকুরের নাম নেওয়া বারণ। ভুলবশত কেউ নাম নিয়ে ফেললে তাঁকে ঠাকুরের নাম তিনবার উচ্চারণ করতে হয়। তবে ঠাকুরের দুটি হাত ও দুটি পা রয়েছে। মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। বুকের ওপর চোখ, নাক, মুখ দেখা যায়।

কথিত আছে নিশাচর ঠাকুরের বাতাস কারোর ওপর লাগলে নাকি সে সঙ্গে সঙ্গে পঙ্গু হয়ে যায়। এই নিশাচর ঠাকুর কারোর ওপর কৃপা করলে তিনি রাতারাতি উন্নতি করেন। নিশাচর ঠাকুর অপদেবতা হিসেবে পূজিত হলেও তাঁর আলাদা করে থান দেখা যায় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিব এবং মা কালীর অনুচর হিসেবেই তিনি পূজিত হন।

বাংলাদেশের বেড়া থানার নাকালিয়ায় নারায়ণ গোস্বামীর বাড়িতে প্রথম এই ঠাকুরের পুজো শুরু হয়েছিল। মহাকাল ভৈরবের অনুচর হিসেবে তাঁর পুজো শুরু করা হয়েছিল। এই মহাকাল ভৈরব হলেন মহাদেব। এইখানে একসঙ্গে অনেক দেবদেবীর পুজো করা হত। সবার উপর গড়ুরের কাঁধে চেপে মহাকাল ভৈরবের মূর্তি। গরুড়ের ঠিক নীচেই থাকত নিশাচরের গাঢ় নীল রঙের মূর্তি। তার নিচে শায়িত থাকতেন ভোলানাথ।

পরবর্তীকালে নদীর স্রোতে নাকালিয়া জলের তলায় তলিয়ে যায়। ‌ মহাকাল ভৈরবের স্থান পরিবর্তন হয়। ‌ সেখানে পুজোর দায়িত্ব পান নারায়ণ গোস্বামীর আত্মীয় সুনীল চন্দ্র রায়।

বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের জামিরতায় নিশাচরের পুজো হয় অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যায়। আগের বছরের মূর্তি বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্দিরে। এখানে নিশাচরের সঙ্গে আরও ১২ জন দেব দেবতার পূজো করা হয়। সিরাজগঞ্জের জামিরতা ছাড়াও শাহজাদপুর থানার চক তলায় ঋষি কালির বাড়িতে নিশাচরের থান রয়েছে। গত কুড়ি বছর ধরে সেখানে পুজো হয়ে আসছে। এখানে পৌষ মাসের অমাবস্যার পূজো হয়।

এছাড়াও বাংলাদেশের পাবনা জেলার বেড়া থানার খাপুরার চরপাড়ায় মা কালীর সঙ্গে নিশাচরের থান দেখা যায়। এইখানে পুজো হয় জৈষ্ঠ্য মাসে। প্রায় পঞ্চাশ বছর থেকে এই থানে পুজো হয়ে আসছে। প্রতিবছর মূর্তি পাল্টানো হয় না এখানে। বেশ কয়েক বছর গেলে চাঁদা তুলে নতুন মূর্তি স্থাপন করা হয়।

জামিরতায় এই নিশাচরের সঙ্গে আর একজন ভূত দেবতার বেশ মিল পাওয়া যায়। বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিম দিকে দোহার নবাবগঞ্জ সড়কের দক্ষিণ দিকে যে ইমামনগর সেতু আছে সেই সেতুর দক্ষিণ দিকে নিসকাইন্দানামে এক ভূত দেবতার ধানের খোঁজ পাওয়া যায়। এখানে মূর্তিটিও একেবারেই নিশাচর ঠাকুরের মত। মূর্তির কোন মাথা নেই। বুকের উপর চোখ, নাক আর মুখ আঁকা।

খুব সাধারণ কিছু উপচার দিয়ে পুজো করা হয় নিশাচর ঠাকুরের। তবে আজও লৌকিক অপদেবতা হিসেবেই পূজিত হন নিশাচর ঠাকুর

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...