ভক্তকবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’। শ্যামাঙ্গী সেই মেয়ের নাম, ‘কালী’। ‘দুর্গা’, ‘কালী’-আদ্যাশক্তি মহামায়ার একই সত্তার দুই রূপ। দুর্গা গৌরবর্ণা, তাই তাঁর নাম 'গৌরী'; কালী শ্যামবর্ণা, তাই তিনি 'শ্যামা'। দুজনেই অশুভশক্তির সমূল বিনাশ ঘটিয়ে শুভশক্তিকে রক্ষা করেন; ভক্তের কাছে তাঁরা দুজনেই ধরা দেন মা ও মেয়ের স্নেহমাখা বাৎসল্য নিয়ে। মেয়ের রূপ ধরে তিনি কখনও ভক্ত রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দিয়ে যান, কখনও বা জননীরূপে ভক্তকে কৃপা করে যান। এরইজন্য একদা দক্ষিণেশ্বরী ভবতারিণীর সঙ্গে ভক্তসন্তান গদাধরের কত না মান-অভিমানের পালা চলেছে! ছেলে আগে না খেলে প্রায়ই তিনি নৈবেদ্য গ্রহণ করতেন না, গদাই নিজে নৈবেদ্য খেয়ে মাকে খাইয়ে দিলে তবেই মায়ের মুখে ফুটত মধুর হাসি। এমন ঘটনা 'রামায়ণ'-এর রাম-শবরীর বাৎসল্য ও স্নেহ মিশ্রিত ভক্তিপূজার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
দেবী কালিকা শুধুই অশুভশক্তিবিনাশিনী নন, তিনি তিমিরবিনাশিনী, তিনি জ্ঞানদাত্রীও। তাঁর কালো শরীর আমাদের মনের অন্ধকার, মোহের অন্ধকার, যুগের অন্ধকার, জ্ঞানের অন্ধকারের প্রতীক; তাঁর অন্তরের ঐশী-প্রভা দিয়ে তিনি ভক্তের জীবন থেকে এই সমস্ত অন্ধকার দূর করেন। তিনি আসলে ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’। তাঁকে দেখেই প্রজ্ঞাকামী কবি বলেছিলেন-‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ অর্থাৎ, 'আমায় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে চলো গো মা'! স্বামী বিবেকানন্দও মায়ের কাছে তাই জ্ঞান কামনা করেছিলেন, প্রকৃত জ্ঞান থেকেই তো আসে মোক্ষ। তাই তিনি মোক্ষদাত্রীও।
এই যে দীপাবলির আলোকমালা-আকাশপ্রদীপ, এও আসলে দেবী কালিকার তিমিরবিনাশী রূপের কথাই বলে। আলোক তো ‘জাগরণের’ প্রতীক। যতক্ষণ আলো জ্বলে; ততক্ষণ চরাচর জেগে থাকে, অন্তর জেগে থাকে। তাই মা শ্যামার আবাহনের সূত্র ধরে দীপাবলির আলো সেই অন্তরকে সতত জাগিয়ে রাখার বার্তাই আমাদের কাছে সম্বৎসর জানিয়ে দিয়ে যায়।