আমাদের শহর নেই। আমাদের গ্রাম নেই। আমাদের শুধু পথ আছে। দিগন্ত ছোঁয়ার ইচ্ছে আছে। সেই অন্তবিহীন পথে চলার শক্তি আছে। একাকী পথ আসলে একটা খোঁজ। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। নিজেকে খোঁজা চলে নিরন্তর। আমরা এই খোঁজকে এড়াতে পারিনা। কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি কখনো বেঁধে দেয় এই সন্তানের পথকে। তবুও বাঁধন উপেক্ষা করে ছুটে চলতে হয়। গন্তব্য তখন দিকশূন্যপুরের পথ দেখায়। এই দিকশূন্যপুরের পথে ছুটে চলাকেই বলা যেতে পারে একাকী ভ্রমন। সোলো ট্র্যাভেলিং।
একাকী ভ্রমণ বর্তমানে ভ্রমণের একটি বহু-চর্চিত ক্ষেত্র। এ যেন এক পথে দুম করে ঝাঁপিয়ে পড়া। কখনো প্ল্যানিং করে সাজিয়ে গুছিয়ে, কখনো আবার একেবারে এক ছুট্টে বেরিয়ে পড়া। দলছুট
হয়ে নিজের সঙ্গে মেশা।
এ যেন কবিগুরুর কথাকেই অনুসরণ করা। "যেমন করে ঝর্ণা নামে দুর্গম পর্বতে/নির্ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে পড় অজানিতের পথে।"
নবনীতা দেব সেনের সেই 'ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে'র কথা মনে আছে? রেশন ট্রাকে চেপে এক মহিলা পাড়ি দিচ্ছেন তিব্বত সীমান্তে। ভয়ডরহীন তিনি। সেই অদ্ভুত কাহিনীর মত বাস্তবের ভ্রমণপিপাসুরাও আজকাল বন্ধু করেছে এই একাকী ভ্রমনকে।
সমীক্ষা বলছে ভ্রমণের নানা ক্ষেত্র বেশ পরিবর্তিত হয়েছে এখন। কোভিড পিরিয়ডের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলির মধ্যে পর্যটন শিল্প অন্যতম। এবং এই পর্যটন শিল্পের ক্ষতি শুধু নির্দিষ্ট একটা শিল্পকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। বরং এর সঙ্গে পরিবর্তন ঘটিয়েছে আরো অনেক বিষয়ের। পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত থাকা মানুষদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়েছে। সেই ক্ষতি এখনো পূরণ হয়নি বলেই জানাচ্ছে সমীক্ষা।
মনোবিদরা বলছেন ক্ষতি হয়েছে মানুষের মনের। একঘেয়ে জীবন যাপনে তিতিবিরক্ত মানুষ কখনো জেনে-বুঝে বা অজান্তে আঘাত করে ফেলেছে নিজেদের আপনজনকে। যে ছোট ছোট মুহূর্ত উদযাপনে বা একে অপরের সঙ্গে নির্ভেজাল ভাবে কাটানো যেত ভ্রমণের মাধ্যমে, সেই মুহূর্তের অন্দরে প্রবেশ করেছে বিরক্তি, কোথাও সম্পর্কের মাঝে দেওয়াল উঠেছে। তাই করোনা পরবর্তী সময়ে মনোবিদরা বারবার ভ্রমণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
কিন্তু এখনো অনেকেই কোভিড-পরবর্তী জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মানিয়ে নিতে পারেননি। তাই পর্যটন ক্ষেত্র সম্পূর্ণরূপে ফিরে আসেনি নিজের জায়গায়। এইরকম পরিস্থিতিতেই একাকী ভ্রমণ অর্থাৎ সোলো ট্র্যাভেলিং-এর জন্ম। জন্ম বললে হয়তো ভুল বলা হয়, বলা যেতে পারে একাকী ভ্রমণের বাড়-বাড়ন্ত এই সময়ে। অনেকেই আজকাল ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন একা একাই। বন্ধু নেই! কে বলেছে সঙ্গী নেই?
ওই যে ঝিলমিল করা রাস্তা, সবুজ বনানী, কখনো সুউচ্চ পাহাড়, কখনো বা গর্জন করা সমুদ্র যে কেউ বন্ধু হতে পারে। নিজের টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর অনেকটা ইচ্ছে-শক্তি এই দুই মিলেই বাঙালি এখন মেতে উঠেছে একাকী ভ্রমণ অর্থাৎ সোলো ট্র্যাভেলিং-এ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন একাকী ভ্রমণ বেশ নির্ঝঞ্ঝাট। এই যেমন আপনি হয়তো বেড়াতে গিয়ে সাজতে একেবারেই পছন্দ করেন না, প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির সাজ দেখাটাই আপনার আনন্দের উৎস, অথচ আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনীটি বেড়াতে গিয়েও বেশ খানিকটা সময় ব্যয় করে সাজগোজে, মনে মনে বিরক্ত হলেও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অথবা আপনার ইচ্ছে সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বেরোনো আর একেবারে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে দিনের শেষে বাড়ি ফেরা, এই হোক বেড়ানোর রুটিন, কিন্তু আপনাদের ভ্রমণসঙ্গীরা ভ্রমণের সঙ্গে রিল্যাক্স করতেই বেশি পছন্দ করেন, মুখ ব্যাজার করেও আপনাকে এটাই মেনে নিতে হয়। পর্যটনবিদরা বলছেন একাকী ভ্রমণে এই সবটুকু এড়ানো সম্ভব। নিজের অন্তরে অনেকখানি অক্সিজেন ভরে নেওয়া যায় এই সোলো ট্র্যাভেলিং-এ।
তবে একাকী ভ্রমণের ঝুঁকির কথা অস্বীকার করা যায় না। ব্যাগ গোছানো, টিকিট কাটা, হোটেল খুঁজে বের করা, সর্বোপরি নিজের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এই সবকিছুই একাকী ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য শর্ত। এই সবটা তদারকি করে তবেই এগোনো উচিত ।
বর্তমানে অনেক মেয়েরাই একাকী ভ্রমণ করছেন। মেয়েদের জীবন এখনো আমাদের সমাজে অনেকটাই আলাদা। তাই ব্যস্ত দিনের ফাঁকে এক মুঠো অক্সিজেন ভরে নেওয়ার জন্য একাকী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ছেন তারা। মনোবিদরা বলছেন একাকী ভ্রমন মনের জন্য খুব ভালো খাদ্য। তবে অবশ্যই সমস্ত রকম সাবধানতা মেনেই এই সোলো ট্র্যাভেল করা উচিত। তবেই অন্তরকে পরিপুষ্ট করা একাকী ভ্রমণ হয়ে উঠবে অন্তরাত্মার উত্তরণ-পথ।