গোয়েন্দা-সাহিত্য সাহিত্য জগতের এমন এক অলংকার, গভীরতা ও গোপনীয়তাই যার উপজীব্য। গোয়েন্দা কাহিনী যাঁর হাত ধরে নাবালকত্বের গণ্ডি পেরিয়ে সাবালক হয়েছে তিনি স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সী। যদিও নিজেকে গোয়েন্দা বলতে নারাজ ব্যোমকেশ বক্সী। তিনি সত্যান্বেষী। সত্যের পরশপাথর খোঁজা যাঁর জীবনের ব্রত। বন্ধুসম অজিতকে সঙ্গে নিয়ে সত্যের অনুসন্ধান করতে থাকা মানুষটি তাঁর বুদ্ধির দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন পাঠককূলের মধ্যে। ১৯৩৩ সালে প্রথম প্রকাশিত গল্প 'সত্যান্বেষী'। অতুল নামের এক সাদামাটা যুবকের ছদ্মবেশে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধারী এই টিকটিকির দেখা পায় অজিত। তখনো অতুল ব্যোমকেশ হয়ে ওঠেনি। অজিতের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হওয়ার পথ চলাও সেভাবে শুরু হয়নি। পথের কাঁটায় প্রথম আবির্ভাব এই সত্যের পূজারীর। তারপর 'সীমান্ত হীরা', 'মাকড়সার রস', 'অর্থমনর্থম', 'চোরাবালি' ইত্যাদি তীক্ষ্ণ কাহিনীর মাধ্যমে অতুল হয়ে উঠেছে ব্যোমকেশ বক্সী। সত্যান্বেষী। আর অজিতও নিজের সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে মেতে উঠেছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অজিত বন্দোপাধ্যায়। প্রায় ৩৫টি গল্পের মাধ্যমে সাবালক হতে হতে অবশেষে "লোহার বিস্কুট"-এ গিয়ে প্রবীণ হয়ে অমরত্ব লাভ করেছে ব্যোমকেশ বক্সী। ১৯৭০সালে সর্বশেষ প্রকাশিত ব্যোমকেশের গল্প 'লোহার বিস্কুট'। তারপর 'বিশুপাল বধ' শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত শেষ অসমাপ্ত ব্যোমকেশ কাহিনী। লেখকের প্রয়াণে থেমে যায় সৃষ্টি। পাঠককুল বঞ্চিত হয় ব্যোমকেশ বক্সীর নতুন ক্ষুরধার রহস্যের জমজমাট সমাধানের উপাখ্যান থেকে।
ব্যোমকেশ বক্সীর গল্প যেন সময়ের দলিল। দেশভাগের মতো সমস্যা থেকে শুরু করে সম্পর্কের জটিলতা, বিশ্বযুদ্ধ, লোভ-লালসা, কামনার করাল ছায়ায় জীবনের ওঠাপড়া এই সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে। ব্যোমকেশের প্রত্যেকটি গল্পই বাস্তবতার আঙিনায় জীবনের কথা বলেছে। কোথাও জীবন উদযাপিত হয়েছে, আবার কোথাও মনের রিপু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে জীবন। ঘনিয়ে এসেছে মৃত্যু। জন্ম হয়েছে অপরাধের। প্রত্যেকটি গল্পই শুধু অপরাধ আর তার সমাধান সূত্রের কাছে আমাদের পৌঁছে দেয়নি ক্রিমিনাল সাইকলজির অলিগলি ঘু্রিয়ে এনেছে শরদিন্দু বাবুর এই সাহিত্য সৃষ্টি। এই গল্পগুলোর কথক অজিত বন্দোপাধ্যায়। ব্যোমকেশ এর সহযোগী। পারিবারিক বন্ধুও বটে। ব্যোমকেশ নারী চরিত্র বর্জিত নয়। স্ত্রী সত্যবতী ও পুত্র খোকাকে নিয়ে পূর্ণ সংসার করেছে। তার মাঝেই সমাধান করে গেছেন দুর্দান্ত সব রহস্যের। অর্থমনর্থম গল্পের সত্যবতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর। বুদ্ধিমত্তা ও সারল্যের সংমিশ্রণে সত্যবতী প্রকৃত অর্থেই ব্যোমকেশের সহধর্মিনী।
সাহিত্যের পাতা থেকে সিনেমার পর্দা সর্বক্ষেত্রে শরদিন্দুবাবুর এই সাহিত্য বাঙালির হৃদয়াবেগের সাক্ষী। সাহিত্যের ভাষা উপন্যাসগুলোর মতই সুন্দর ও অলংকৃত। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার সুতো দিয়ে বোনা ব্যোমকেশের প্রতিটি গল্প। প্যাঁচালো রহস্যের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট সমাধান সূত্র জুড়েজুড়ে ব্যোমকেশ বক্সী সমাধান করেছে রহস্যের মালার। রহস্যের মালাও মস্তিষ্কের গোপন গলিঘুঁজিতে লুকিয়ে থাকা অপরাধবোধ দিয়ে মনোরম করে গেঁথেছেন লেখক। রহস্যের জট ছাড়াতে ছাড়াতে এই সাহিত্য অনেক সময়ই সামাজিক অবক্ষয়ের প্রশ্ন তুলে ধরেছে পাঠকের কাছে। ব্যোমকেশের প্রতিটি গল্পেই রয়েছে চিত্রনাট্যের উপাদান। বনেদিয়ানায় মোড়া গল্পগুলো সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের সুস্পষ্ট ছবি এঁকেছে। সত্যান্বেষীর স্ত্রীও এই উপন্যাসে যথেষ্ট সমাদৃত। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পাওয়া গেছে। সত্যবতীর সঙ্গে কথোপকথন চলাকালীন অনেক রহস্যের সমাধান সূত্র খুঁজে পেয়েছে ব্যোমকেশ বক্সী। ধুতি-পাঞ্জাবি, হ্যারিসন রোডের বাড়ি, মেস বাড়ি ব্যোমকেশ বক্সীর গল্পগুলোকে প্রাণবন্ত করেছে আরো। ব্যোমকেশ সাহিত্যে অজিতের চরিত্রটিও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি "মাকড়সার রস" ও "শৈল রহস্য" অজিত একাই সমাধান করেছে, তবে ব্যোমকেশের বুদ্ধিদীপ্ত উপদেশের সঙ্গে। সবমিলিয়ে ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনী সাহিত্যের অন্যতম পরশ পাথর যার ছোঁয়ায় বাংলা সাহিত্য তথা ভাষা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।