বাংলার লৌকিক দেবতা পঞ্চানন ঠাকুর

এই বঙ্গে মূলত গ্রামীণ এলাকায় লৌকিক দেবতার সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। পল্লীবাংলার তেমনই এক লৌকিক দেবতা হলেন পাঁচুঠাকুর

পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ বা পাঁচু ঠাকুর এক খ্যাতিমান লৌকিক দেবতা, শুধু খ্যাতনামা বললেও কম বলা হয় তিনি হলেন গ্রাম বাংলার জনপ্রিয়তম লৌকিক দেবতা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোনও কোনও জায়গায় পাঁচু ঠাকুর 'বাবাঠাকুর' নামেও পরিচিত। মূলত রাঢ়-বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা, বর্ধমান, নদিয়া ও বাঁকুড়াতে এঁর পুজো হয়ে থাকে। প্রান্তিক কলকাতাতেও​ কোথাও কোথাও পঞ্চানন ঠাকুর পুজো পান। অনেকেই মনে করেন, ভাগিরথী প্রবাহের নিম্নধারার মাধ্যমে জনসংস্কৃতির বিভেদ্যতায় রাঢ়-বাংলার মুখ্য লোকদেবতা ধর্মঠাকুর ক্রমেই পঞ্চানন রূপের মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণ শিবমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

প্রচলিত বিশ্বাস মতে মনে করা হয় পঞ্চানন ঠাকুর হলেন দেবাদীদেব শিবেরই আরেক রূপ। এটিই সংখ্যাগরিষ্ঠের মত। আবার অন্যমতে, তিনি শিবের পুত্র। মূলত গ্রামরক্ষক, শিশুরক্ষক রূপে পঞ্চানন ঠাকুর পূজিত হন।তবে সন্তানদাতা, শস্যদেবতা রূপেও তাঁর পুজো প্রচলন হয়েছে। তিনি গর্ভস্থ শিশুকে রক্ষা করেন। শিশুদের ধনুষ্টংকার রোগ থেকে রক্ষা করেন। তাই প্রসূতি ও মায়েদের কাছে তিনি পরম আরাধ্য দেবতা। পঞ্চানন ঠাকুরের উদ্দেশ্যে ছাগ বলিরও রেওয়াজ হয়েছে।

 

Panchanan1

 

গ্রামদেবতা রূপে মন্দিরের মধ্যে অথবা গাছতলায়, বটতলায় ঠাকুরের পুজো করা হয়। একটি গাছকে কেন্দ্র করেই বাবার পুজো হয়। পঞ্চানন ঠাকুরের পুজোর জায়গা বলেই গ্রাম বাংলায় অনেক গাছতলার নাম হয়ে গিয়েছে পঞ্চানন তলা।

কোথাও মাটির মূর্তিতে, কোথাও শিলা বা ঘটের প্রতীকে, কোথাও আবার শিলা রূপে হাতি ও ঘোড়া মূর্তিতে তিনি পূজিত হন। সাধারণত শনি ও মঙ্গলবারে পুজো হয়। বহু মানুষেরা মনস্কামনা নিয়ে পুজো দিতে আসেন ঠাকুরের কাছে। মনোবাঞ্ছা পূরণের দেবতা হিসেবেও পঞ্চানন ঠাকুরের পুজো হয়। মনোবাসনা পূরণ হলে ঘোড়ার মূর্তি, সিন্নি ইত্যাদি দিয়ে পঞ্চানন ঠাকুরের মানত পূরণের পুজো দেন সকলে। গ্রাম-গঞ্জে পঞ্চানন ঠাকুরের মেলাও বসে

পঞ্চানন ঠাকুরের গায়ের বর্ণ লাল, তাঁর চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী। বড় গোলাকার রক্তাভ তিনটি চোখ ক্রোধোদ্দীপ্ত। মূর্তিতে ঠাকুরের প্রশস্ত ও কালো টিকালো নাক বর্তমান, দাড়ি নেই, গোঁফ রয়েছে যা কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং জটা বুকে পিঠে ছড়ানো। কানে ধুতরা ফুল গুঁজে রাখা। মূর্তির উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে থাকে বাঘছাল, আবার কোনও কোনও জায়গায় নিম্নাঙ্গে কাপড় পরানো থাকে।

 

Panchanan2

 

গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু, পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পঞ্চরংয়ের বা পাঁচমুখো গাঁজার কলকে। পঞ্চানন ঠাকুরের আবার পার্শ্বজ পরিষদ রয়েছে, তাঁর অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামের দু-জন অপদেবতা। এঁর সঙ্গেই থাকে মামদো ভূত, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি। 

আমাদের প্রাচীন সাহিত্য জুড়ে পঞ্চানন ঠাকুরের কথা ছড়িয়ে রয়েছে, ফলে অনুমান করা যায় পঞ্চানন ঠাকুরের পুজোর প্রচলন বহু প্রাচীন। মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যে পঞ্চানন ঠাকুরের উল্লেখ রয়েছে। দ্বিজ দুর্গারাম রচিত পঞ্চাননমঙ্গলে রয়েছে, "পঞ্চমুখে গান কর ত্রিলোচন।"

তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব-এ পাওয়া যায়,
"পঞ্চানন দেব প্রায় অশ্বত্থ তলায়।
মধ্যমাঠে সরোবর তীর দেখা যায়।।"
রূপরামের ধর্মমঙ্গলেও পঞ্চাননের উল্লেখ রয়েছে,    
"কামারহাটে পঞ্চানন্দ বন্দে জোড় হাতে।
ছেলেদের জন্য কত মেয়ে ওষুধ যায় খেতে।"
আজও রাঢ় বাংলার নানা প্রান্তে পঞ্চানন ঠাকুরের পুজো হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...