চৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে চৈতন্য মহাপ্রভু ও মুসলমান কাজীর মধ্যে এক দ্বন্দ্ব হয়েছিল, যে দ্বন্দ্বের পর মুসলমান কাজী চৈতন্যের ভক্তে পরিণত হন। অদ্ভুতরকম ভাবে নাম সংকীর্তনে বাধাদানকারী কাজীই এই দ্বন্দ্বের পর হয়ে উঠলেন সংকীর্তনের প্রধান সহায়ক! কীভাবে ঘটল এই রূপান্তর? চৈতন্য মহাপ্রভু ও চাঁদ কাজীর সেই দ্বন্দ্বে আসলে কী ঘটেছিল? কীভাবেই বা পরিবর্তন হল কাজীর মন? তা অনেকেরই অজানা। আজকের নিবন্ধে সেই কথাই জানব।
চৈতন্য মহাপ্রভু বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য নবদ্বীপে ভগবানের নাম সংকীর্তন প্রচার করতে শুরু করেন। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জনপ্রিয়তা দেখে এই সময় কিছু ব্রাহ্মণ ঈর্ষান্নিত হয়ে পড়েন। তাঁরা ঠিক করেন যে, মহাপ্রভুর প্রচারকার্যে নানা রকম বিঘ্ন তৈরি করবেন। তাঁরা এতটাই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিরুদ্ধে নবদ্বীপের মুসলমান কাজীর কাছে নালিশ করে বসেন।
সেইসময় বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ। বঙ্গভূমি ছিল পাঠানদের অধীন। নবদ্বীপের মুসলমান কাজী ব্রাহ্মণদের সেই অভিযোগটিকে ভীষণ গুরুত্ব দান করেন এবং তিনি নিমাই পণ্ডিতের অনুগামীদের উচ্চস্বরে হরিনাম সংকীর্তন করতে নিষেধ করে দেন। কিন্তু কাজীর নিষেধ না মেনে মহাপ্রভু চৈতন্যর অনুগামীরা আগের মতই সংকীর্তন করতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্তন বন্ধ করার জন্য তার গোটাকয়েক পেয়াদা পাঠিয়ে দেন সংকীর্তনের জায়গায় ও তারা সংকীর্তনকারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয়।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই ঘটনা শুনে রেগে যান। ধর্মের অবমাননা তিনি সহ্য করতে পারেন না, তখন তিনি মুহূর্তের মধ্যেই তার সকল অনুগামীদের নিয়ে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেন ও সেই অনুযায়ী কাজ করেন।
মহাপ্রভু হাজার হাজার মৃদঙ্গ ও করতাল নিয়ে এক লক্ষ মানুষকে নিয়ে এক বিরাট শোভা যাত্রার আয়োজন করেন। কাজীর আইন অমান্য করে এই শোভাযাত্রা নবদ্বীপের পথে পথে হরিনাম কীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে শোভাযাত্রা যখন কাজীর বাড়িতে এসে পৌঁছায় তখন ভয়ে কাজী তার বাড়ির উপরতলার একটি ঘরে লুকিয়ে পড়েন। সেই বিশাল জনসমাবেশ কাজীর বাড়ির সামনে সমবেত হয়ে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাদের শান্ত হতে বলেন।
এরপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আশ্বাসবাণীতে বিশ্বাস করে কাজী তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে গ্রাম সম্পর্কে ভাগ্নে বলে সম্বোধন করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কাজী তাঁকে বলেন যে গ্রাম সম্পর্কে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাতামহ শ্রী নীলাম্বর চক্রবর্তী হচ্ছেন তার মামা সেই সূত্রে মহাপ্রভুর মা শ্রীমতি শচীদেবী হচ্ছেন তার ভগ্নি তাই তিনি মহাপ্রভুকে জিজ্ঞেস করেন যে মামার প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়া কি ভাগ্নের উচিত ছিল? মহাপ্রভু তখন উত্তর দেন, যেহেতু কাজী হচ্ছেন তার মামা তাই তার কর্তব্য ছিল যথাযথভাবে ভাগ্নেকে গৃহে স্বাগত জানানো। এইভাবে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয় এবং দুই বিদগ্ধ পন্ডিত কোরান ও হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করতে শুরু করেন।
কাজী তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। একই সাথে সংকীর্তন যজ্ঞে যাতে কেউ কখনও বাধা না দেয় তা নিশ্চিত করতে কাজী সেদিন ঘোষণা করলেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রবর্তিত সংকীর্তন যজ্ঞে কেউ যেন কখনও বাধা না দেয় এবং তিনি তার উইলেও লিখে যান যে তার বংশের কেউ যদি সংকীর্তনে বাধা দেয় সে সেই মুহূর্তে বংশচ্যুত হবে।
নবদ্বীপের শ্রীধাম মায়াপুরের সন্নিকটে শ্রী চাঁদ কাজীর সমাধি এখনও বর্তমান আছে এবং ভগবত ভক্তরা এখনও সেখানে গিয়ে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। কাজীর বংশধরেরা এখনও রয়েছেন এবং তারা কখনও সংকীর্তনে বাধা দেন না। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিরীহ বৈষ্ণব ছিলেন না। বৈষ্ণব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের নির্ভীক ভক্ত এবং প্রয়োজন হলে তিনি সিংহ বিক্রমে যথার্থ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। যথার্থ ভক্তরা অহিংস জীবনযাপন পালন করলেও তারা অন্যায় কখনই সহ্য করেন না।