মোয়ার জন্য যেমন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার জয়নগর সুবিখ্যাত, তেমনই মাটির পুতুল তৈরির জন্য সুখ্যাত মজিলপুর। দুই জনপদই গায়ে গায়ে অবস্থিত এবং দুটোই প্রায় সাড়ে চারশো বছরের প্রাচীন।
মজিলপুরের পুতুল তৈরির ঐতিহ্য ও তার উদ্ভবের ইতিহাস, তার বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি ভালোভাবে জানতে হলে জয়নগর ও মজিলপুর-এই জনপদ দুটির পত্তনের ইতিহাস আগে জানতে হবে। আসুন, প্রথমে সেটাই জেনেশুনে নিইঃ
কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, যশোর-বিক্রমপুরের জমিদার গুণানন্দ মতিলাল একদা নৌকোযোগে গঙ্গাসাগর যেতে গিয়ে দেবী জয়চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পেলেন। স্বপ্নে নির্দেশ পেলেন যে, কালীঘাট পেরিয়ে বয়ে আসা আদিগঙ্গাতীরের জঙ্গলে শিলারূপী দেবী অবস্থান করছেন। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেবীকে পেয়ে সেখানেই গড়ে তুললেন মন্দির। এবং, সেই মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললেন নতুন জনপদ। দেবীর নামে সেই জনপদের নাম দিলেন, ‘জয়নগর’।
অনতিকাল পরেই আদিগঙ্গার ধারাটি ক্ষীণ হতে হতে ক্রমে কোথাও তা পুকুরের আকার নিল, কোথাও মজে গিয়ে চড়া পড়ল। এই মজে যাওয়া নদীর ওপরেই একদিন জয়নগরের গা ঘেঁষে গড়ে উঠল আর-এক নতুন বসতি, যার নাম হল, ‘মজিলপুর’। ‘মজা’ থেকে ‘মজিল’।
বারোভুঁইয়াদের এক ভুঁইয়া ছিলেন যশোরের প্রতাপাদিত্য। তিনি মোঘলদের হাতে পরাজিত হতেই তাঁর মুনশি চন্দ্রকেতু দত্ত সপরিবারে গোপনে মজিলপুরে পালিয়ে এসে প্রাণে বাঁচলেন। এবং পাকাপাকিভাবে বাস করতে শুরু করলেন এখানেই। তাঁরই সঙ্গে মোঘলদের হাত থেকে বাঁচতে অনেক পরিবারই যশোর থেকে পালিয়ে এসেছিল, তারাও এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেল। এঁদের মধ্যেই ছিলেন কালীচরণ পেয়াদা ও তাঁর পরিবার।
কালীচরণ মজিলপুরবাসী হয়ে ‘দাস’ পদবী গ্রহণ করে হলেন ‘কালীচরণ দাস’। তাঁর পূর্ববঙ্গের বৃত্তি ছিল মৃৎকর্ম, পদবী ত্যাগ করলেও তিনি পেশা ছাড়লেন না।
সুতরাং, বৃত্তির প্রয়োজনেই কালীচরণ পুতুল তৈরি শুরু করলেন। কারণ, তিনি খুব ভালো টেপা পুতুল তৈরি করতে পারতেন।
কালীচরণের দুই ছেলে জানকী এবং রাম। তাঁরাও মৃৎশিল্পকেই নিজেদের পেশা হিসেবে বাছলেন। তবে বাড়িতেই আটকে রইলেন না। তাঁরা সুদূর দক্ষিণ ছাড়িয়ে উত্তরের কুমোরটুলিতে এসে ডাকের সাজ তৈরির কাজ নিলেন।
কাজ করতে করতে অল্পদিনেই জানকী কুমোরটুলি-ঘরানাকে আত্মস্থ করে ফেললেন। তখন সেই ঘরানায় খানিকটা নিজস্বতা মিশিয়ে বাবার মতো স্বাধীনভাবে পুতুল তৈরিকেই আপন পেশা হিসেবে বেছে নিলেন।
কিন্তু কুমোরটুলির গন্ধমাখা ঐতিহ্যে দাঁড়ি টানলেন জানকীর পুত্র হরিনাথ। তিনি বাপের মতো কুমোরটুলি-ঘরানার ঐতিহ্যকে বহন করলেন না। পুতুল তৈরিতে নিজস্বতা আনলেন। আর সেই নিজস্বতা আনতে গিয়ে তিনি সুন্দরবন-মজিলপুরের প্রবহমান সামাজিক-ধর্মীয় ও লোকসংস্কৃতির প্রবাহকে তাঁর তৈরি পুতুলের বৈশিষ্ট্যে ধরলেন। কম রঙ ব্যবহার করে রাখলেন পুতুলের ভরাট-সরল গড়ন। গড়ে তুললেন বাংলার পুতুলশিল্পে ‘মজিলপুর ঘরানা’।
ঘরানাটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ হল হরিনাথের তৃতীয় উত্তরপুরুষ মন্মথনাথের হাত ধরে। মন্মথ বিশ শতকের মানুষ। তিনি সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবীদের পুতুল তৈরিতে স্বতন্ত্র কৃতিত্ব দেখিয়ে বিখ্যাত। তাঁর আগে বিভিন্ন প্রতীকে সুন্দরবনে অধিকাংশ লৌকিক দেবদেবীরই পুজো হত। লোকগাথা ও বন্দনা শুনে শুনে তিনি তাদের আকার প্রথম মূর্তিতে ধরলেন। স্বভাবতই এই ভাবে মন্মথর হাত ধরেই সুন্দরবন অঞ্চলে মূর্তিতে লৌকিক দেবদেবীর পুজো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
মন্মথর হাত বেয়ে ছাঁচের পুতুল তৈরির ধারাটিরও ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটে। মন্মথ নিজেই ছাঁচ তৈরি করতেন। তিনি একশোর বেশি নতুন ধরণের পুতুলের ছাঁচ তৈরি করেছিলেন। এর মধ্যে ‘নারায়ণ’, ‘মাতাল শিব’, ‘বরাহ অবতার’, ‘গণেশ জননী’, ‘বেনে বউ’, ‘বাবু-বিবি’, ‘মেম’, ‘সেপাই’, ‘বুড়োবুড়ি’, ‘মাতাল’, ‘গোয়ালা বউ’, ‘হাতি’, ‘কাকাতুয়া’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ ছাঁচ এখনও আছে। তবে, সব ছাঁচের পুতুল এখন আর গড়া হয় না।
মন্মথর তৈরি ছাঁচগুলি দেখার মতো জিনিস। মাটির পাতলা চাদরে তৈরি। তাতেও শৈল্পিক উদ্ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯৮৬-তে মন্মথর তৈরি ‘জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম’ মূর্তি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায়। কিন্তু, পুরস্কার নিতে যাওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। অপুত্রক মন্মথর হাত ধরে মজিলপুরের পুতুলের ধারাকে বয়ে নিয়ে চলেছিলেন ভাইপো পাঁচুগোপাল। তাঁর পরে এখন এই ধারাটি ধরে রেখেছেন পাঁচুগোপালের পুত্র শম্ভুনাথ।
মজিলপুরের পুতুল-ধারায় দাসবংশের উত্তরাধিকারের একটা ক্রম আমরা এতক্ষণের আলোচনায় তুলে ধরলাম। তার মানে এই নয় যে, পুতুলের এই ধারাটি মজিলপুরে শুধুমাত্র এই পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানকার দাস-সম্প্রদায়ভুক্ত অনেক পরিবারই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তবে মন্মথ-পাঁচুগোপালই যে এই পুতুল ঘরানার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মুখ, এটা অনস্বীকার্য।
উদ্ভবের ইতিহাস তো হল, এবার চলুন এই পুতুলের বিশিষ্টতা কোথায়, সেটা বরং দেখিঃ
প্রাচীন এই ঘরানার পুতুল মূলত দুই ধরণের। ‘টেপা পুতুল’ ও ‘ছাঁচের পুতুল’।
‘টেপা পুতুল’ হল মাটিতে দক্ষ আঙুলের চাপ দিয়ে দিয়ে আকার দেওয়া পুতুল। বানানোর এই ধরণটি থেকেই এর এমন নাম। শুকিয়ে আগুনে পোড়ালে তবেই এ-পুতুল সম্পূর্ণতা পায়। কালীচরণের কাল থেকে চলে আসছে এই পুতুল তৈরির ঐতিহ্য। পাঁচুগোপালের হাতের তৈরি টেপা পুতুলের ধারায় ‘মা’ পুতুলটি ছিল শিল্পবৈশিষ্ট্যে অপূর্ব। বিখ্যাতও।
‘ছাঁচের পুতুল’ অর্থাৎ যে পুতুল ছাঁচে তৈরি হয়। এই ছাঁচ আবার দু’রকম। এক-খোল ও দু-খোল। দু-খোল ছাঁচে তৈরি পুতুলের ভেতরটা ফাঁপা হয়। একটা খোলে পুতুলের সামনের দিকটা তৈরি করা হয়, অন্য খোলটিতে পিছনদিকটি। তারপর দুটি অংশকে জোড়া লাগিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। শেষে রঙ করে তার ওপর রজন ও গর্জন তেল গরম করে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে পুতুলের অঙ্গে জেল্লা আসে, চকচকে হয়।
চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হল, ছাঁচের পুতুলের অঙ্গসৌষ্ঠবে কালীঘাটের পটের একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আসলে, মজিলপুর ঘরানা যেমন স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে নিজস্বতা আহরণ করেছে, তেমনি সমসাময়িক ও সন্নিকটস্থ শৈল্পিক উত্থানকেও সে আপন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আত্তীকরণ করেছে।
সেই প্রেক্ষিতেই উনিশ শতকের বাবু-সংস্কৃতিকে রঙে-রেখায় কালীঘাটের পটুয়ারা যে-ভাবে চিত্রিত করেছিলেন, তাতে বাঙালির বক্ষ্যমাণ আলস্য-বিলাস-ভোগ অঙ্গরেখার টানে অপূর্ব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। এবং, সাধারণের কাছে তা সাদরে গৃহীত হয়ে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। কালীঘাটের পটের এই আদল-সৌষ্ঠব ও জনপ্রিয়তা দুই-ই মজিলপুরের উত্তরসাধকদের আকৃষ্ট করেছিল ও প্রভাবিত হতে প্রলুব্ধ করেছিল। সেই প্রভাবের ছাপই মৃৎপুতুলে তাঁরা রেখে দিয়েছেন।
প্রভাব ওই ‘আদল’-এই সীমাবদ্ধ। চোখের-রেখায় মজিলপুর সকলের চেয়েই আলাদা। সেখানে কালীঘাট নেই, কুমোরটুলি নেই, কেউ নেই। মজিলপুরের সমস্ত পুতুলের চোখেই একটা অপার স্নিগ্ধতা। অদ্ভুত মানবিক। তা দেব-দানব-মানব-পশু যাই হোক না কেন। এই সিগনেচার বৈশিষ্ট্যটির প্রবর্তন হয়েছে বহু পূর্বেই, হরিনাথের হাত ধরে।
মাটির পুতুল নিয়ে খেলবার মতো শৈশব আমাদের সমাজে আর নেই। জাদুমূলক ও পুজো-উদ্দেশ্যের বাইরে যদিও বাংলার পুতুলের বেশিরভাগেরই উদ্ভব শিশক্রীড়ার কথা মাথায় রেখে। তাতে কালক্রমে স্থানিক সংস্কৃতি ও শিল্পীমন বিশিষ্টতার আভরণ দিয়েছে।
সেই আভরণটির জন্যই এই পুতুলগুলি আমাদের কাছে আজও পরম মূল্যবান। তা একদিকে যেমন গৃহসজ্জার অন্যতম উপকরণ; তেমনি অন্যদিকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালায়, লোকশিল্প সংগ্রাহকের কাছে বাংলার স্থানীয় লোকচর্যা-লোকঐতিহ্য এবং বহমান সংস্কৃতির বলিষ্ঠ পরিচায়কও। প্রার্থনা রাখি, বাঙালির ক্ষীয়মাণ এই ‘পরিচায়ক’ আয়ুষ্মান হোক...
তথ্যঋণঃ
১. জয়নগর মজিলপুরের ইতিহাস- ডঃ ভৈরব চন্দ্র মিত্র।
২. পুতুল নেবে গো পুতুল- বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য-আনন্দবাজার পত্রিকা-১২ জানুয়ারি,২০১৪-প্রবন্ধ।
৩. বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুলশিল্প হারালো এক দরদী শিল্পী পাঁচুগোপাল দাস- সঞ্জয় ঘোষ-সংবাদ মন্থন-৩০ জানুয়ারি, ২০১০-প্রবন্ধ।
৪. জয়নগরের ছাঁচের পুতুল- সৌমিত্র কর-আয়নানগর-৩ এপ্রিল ২০১৫- সাক্ষাৎকার।