‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তাঁর প্রথম যৌবনের রচনা। মার্কেন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার হলেও যাতে সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় তার জন্য প্রবল চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই। অন্তত ছ’ থেকে সাত বার মূল রচনার পরিবর্তণ ঘটেছিল। চন্ডীর মাহাত্ম্যের সঙ্গে মিশেছিল চিরায়ত সংস্কৃত কাব্যের বীররস, সঙ্গে টলটলে শিশিরবিন্দুর মতো আটপৌরে বাঙালী হৃদয়ের আর্দ্রভাবটিও ধরেছিলেন তিনি।
তাঁর কলমেই প্রাণ পেয়েছিল বাঙালির শারদ উৎসবের আবাহনকাব্য ‘মহিষাসুমর্দিনী’। তিনিই রচয়িতা।
আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। ছদ্মনাম ‘বাণীকুমার’।
বাবা 'রায়বাঘিনী'-র ইতিহাসকার পণ্ডিত বিধুভূষণ ভট্টাচার্য ও অপর্ণাদেবী। আদি বাড়ি হাওড়ার আঁটপুরে। জন্ম মামাবাড়ি কানপুরে। ছোটবেলা থেকেই কাব্যে মন। সংস্কৃত ভাষায় অসাধারণ দখল। পেয়েছিলেন ‘কাব্যরত্ন’ উপাধিও। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ধ্যানজ্ঞান।নজরুলের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল।
কাব্যচর্চা শুরু হয়েছিল ছাত্রাবস্থায়। স্কুলের মাস্টারমশাই কবি করুণানিধন বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা উত্সাহিত হয়ে। হাওড়া জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজ। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র।
তাঁর কাব্যচর্চার অবশ্য অভিভাবকরা ভালো চোখে দেখেননি। স্নাতক হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা। এবার আর নিস্তার নেই। নিভৃত কাব্য চর্চার অবসর ভেঙে চাকরি নিতে হল টাঁকশালে। কিন্তু মন যে মানে না। ছটফট করে একঘেঁয়ে পরিবেশ। মুক্তি মিলল একবছর পর।
১৯২৭ সালে ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে শুরু হল কলকাতা বেতার কেন্দ্র। অধিকর্তা নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের আগ্রহে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ওরফে ‘বাণীকুমার’ যোগ দিলেন সেখানে। রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে।এই তাঁর মনের মতো কাজ। হেলায় ছাড়লেন সরকারী চাকরি। নিজেকে নিংড়ে দিলেন।
নতুন নতুন অনুষ্ঠানে সেজে উঠল বেতার প্রতিষ্ঠান। সেভাবেই ১৯৩১-এ তৈরি করেছিলেন ‘বসন্তেশ্বরী’। শ্রীশ্রী মার্কেন্ডেয় চন্ডীর বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে। সেই প্রযোজনাতে যুক্ত ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল।
‘বসন্তেশ্বরী’র অনুসরনেই নতুন করে বাণীকুমার তৈরী করলেন গীতিআলেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কলকাতা বেতারের সবচেয়ে প্রথিতযশা প্রযোজনা। বেতার জগতের ইতিহাসে এমন অনুষ্ঠান আর কখনও তৈরি হয়নি। একটা জাইত্র সংস্কৃতির শিকড়ের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ওতঃপ্রোতভাবে।
১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে ষষ্ঠীর ঊষায় সম্প্রচারিত হয় সেই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান হত ‘লাইভ’। পরবর্তী সময়ে ছ’ থেকে সাতবার পরিবর্তন হয় এই রচনার।
বাণীকুমারের নিজের কথায়, ‘‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কলিকাতা বেতারের তথা বাঙলার একটা কীর্তি-স্থাপন করেছে’ দেশ-বিদেশ থেকে এসেছে এই অনুষ্ঠানের বহু অভিনন্দন। অখিলভারত এই অনুষ্ঠানের শ্রোতা, সুদূর প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে যেখানে বাঙ্গালীর অবস্থান-সেইখানেই এই গ্রন্থের প্রচার-মুহুর্তের অনেক পূর্ব থেকে রেডিও-সেট আলো জ্বালিয়ে দেবী-মাহাত্ম্যের বাণী-রসধারা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে থাকে’।
বাণী কুমার আরও অজস্র অনুষ্ঠান করেছেন বেতারে, কিন্তু তিনি ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ লিপিকার হিসেবেই।