রাণীগঞ্জে একই পাড়াতে থাকতেন নজরুল, শৈলজানন্দ আর শৈলেন। তিনজনে একেবারে হরিহর আত্মা। যেন একই বৃন্তে তিনটি কুসুম--মুসলিম, হিন্দু আর খ্রিস্টান। বয়সে তিনজনই কিশোর। স্বভাবে আড্ডাবাজ। তখন শৈলজা লিখতেন কবিতা, নজরুল লিখতেন গল্প আর শৈলেন ছিলেন শ্রোতা। পাড়ার আর সব ছেলেরা সেসব শুনে হাসত, কিছুতেই বিশ্বাসই করত না যে এসব তাঁদের লেখা। ভাবত, অন্য কারও লেখা থেকে চুরি করা। আর তাই নিয়েই তারা ভীষণরকম খিল্লি করত। ফলে, তিন ইয়ারের সঙ্গে তাদের একেবারেই বনত না।
তিন ইয়ারের বন্ধুত্ব ছিল নিখাদ। স্তোকের কোন জায়গা ছিল না। তাই নজরুলের লেখা গল্প আর শৈলজার লেখা কবিতা ভালো না-লাগলে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতে ছাড়তেন না শৈলেন। প্রায়ই নজরুলকে বলতেন, 'শোন, গল্প লিখে কোনদিনই তুমি বঙ্কিমচন্দ্র হতে পারবে না।' আর শৈলজাকে বলতেন, 'কবিতা লিখে খাবো ভাবলে নির্ঘাত মরবে!'
সেই কিশোরকালেই নজরুল আর শৈলজার ছিল ঘাড় অব্দি ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। তা নিয়েও তাদের ঠাট্টা করতে ছাড়তেন না শৈলেন। তবে তাঁর ঠাট্টা দুই বন্ধুর কেউই মোটে গায়ে মাখতেন না, প্রাণখোলা হো হো হাসিতে সটান উড়িয়ে দিতেন হাওয়ায়।
এমনি চলতে চলতে দুম করে নজরুল একদিন পল্টনে যোগ দিলেন। আর ধরলেন কবিতার পথ। লিখলেন, 'মুক্তি' কবিতা। শুরু করলেন নামের পাশে 'হাবিলদার' কথাটি লিখতে। পল্টনের হাবিলদারের পদটিকে তিনি বড্ড ভালোবাসতেন। তাই লেখালেখির ক্ষেত্রেও পদটিকে কাছছাড়া করতে চাইতেন না তখন। কিছুদিনের মধ্যে পল্টন ভেঙে যেতেই বেকারত্ব নিয়ে করাচি থেকে ফিরে এলেন নজরুল। এসে দেখলেন, শৈলজা কবিতা ছেড়ে গল্প লেখায় মন দিয়েছেন। তারপর একদিন নজরুল 'বিদ্রোহী' কবিতাটি লিখলেন, সেই সঙ্গে সাহিত্যজগতে রীতিমতো সাড়া ফেলে নিজের জন্য একটা আলাদা পথ তৈরি করে নিলেন; যে-পথ দিয়ে আগে কেউ যাবার সাহস করেননি, সেই পথ। ওদিকে শৈলজানন্দও 'কয়লাকুঠির দেশে' গল্প লিখে বাংলা ছোটগল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন।
সেই কিশোরবেলায় বন্ধু শৈলেন যেন দেখতে পেয়েছিলেন পথ বদলে নিলেই একদিন উড়বে দুই বন্ধুর বিজয় পতাকার নিশান! যেন তিনি সেদিনই শুনতে পেয়েছিলেন কালের ঘন্টার ধ্বনি! তাই বন্ধুদের ইঙ্গিতে বলেছিলেন, ক্ষেত্র পরিবর্তনের কথা। শৈলেন ছিলেন ক্ষণজন্মা মানুষ, বন্ধুদের প্রতিষ্ঠাপর্বটুকু দেখেই অকালে চলে গিয়েছিলেন। রেখে গিয়েছিলেন শুধু অমলিন স্মৃতি। নজরুল যখন স্মৃতি হারিয়ে সত্তা সংকটে নির্বাক, তখন সাহিত্য ও সিনেমায় প্রতিষ্ঠার যুগ পেরিয়ে শৈলজানন্দ 'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে' স্মৃতিকথা লিখে জানিয়ে গেলেন সময়ের ঢেউ ভাঙা স্রোতেও তিন ইয়ারি কথা তাঁর স্মৃতি-সত্তায় সুগন্ধ ছড়িয়ে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে...