এই সময়ে গুণেন্দ্রনাথের মাথায় এল এক বুদ্ধি। বেঙ্গল থিয়েটার এক দিনের জন্য ভাড়া নিয়ে, নাটকের নট নটী বাদে আর কাউকে প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে বাড়ির মেয়েদের নাটক দেখলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। এক রাতের মধ্যে বেঙ্গল থিয়েটার পরিণত হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। হলের বেঞ্চ সরিয়ে দিয়ে ঠাকুরবাড়ির বৈঠকখানা থেকে আসবাব পত্র নিয়ে এসে হল সাজান হল। হলের মধ্যে শিশু, মহিলা, পুরুষ কেউ বাদ গেল না। দর্শকের আসনে কেবল মাত্র জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সদস্যরা। এ এক ইতিহাস। এরপরই নাটকের মঞ্চে নামলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। এবার নাটকের ভাবনা হল অন্য রকমের, কাহিনী হল প্রকৃতিকেন্দ্রিক। আর রীতিতে নতুন ভাবনা এল গীতিনাট্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মাথায় এল আগেকার দিনের বসন্ত উৎসবের কথা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুরোধে কিছু দিনের মধ্যেই স্বর্ণকুমারী দেবী লিখে ফেললেন বসন্ত উৎসব গীতিনাট্যটি। এই নাটক লেখার পরই শুরু হয়ে গেল রিহার্সাল। ঐ নাটকে অভিনয় করলেন বাড়ির সদস্যরাই। বাড়ির মহিলা পুরুষ সকলে এক সঙ্গে। আবার জোড়াসাঁকোর উদ্যান আলোয় সেজে উঠলো। কারণ, বসন্ত উৎসবের প্রথম অভিনয় হল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতেই।
এরপর থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে চলতে লাগলো গীতিনাট্যের ঝড়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে লিখে ফেললেন একটি গীতিনাট্য 'মানময়ী'। এই নাটকেও বাড়ির সদস্যরা অভিনয় করলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে বেশ কয়েকবার অভিনয় হয়ে গেল নাটকটা। ঠিক এমনি সময়ে রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে বাড়ি ফিরলেন। তখনও ঠাকুর বাড়িতে গীতিনাট্যের হাওয়া বইছে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথও লিখে ফেললেন অপেরা স্টাইলে গীতিনাট্য। বাল্মীকিপ্রতিভা। নাটকের লেখা শেষ হতেই শুরু হয়ে গেল রিহার্সাল। একমাস ধরে চলল এই রিহার্সাল। এই প্রথমবার নাটকটি অভিনয় হল বাইরে। মহর্ষি ভবনের বাইরে তিনতলায় স্টেজ তৈরী করা হল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সাজলেন বাল্মীকি। হেমেন্দ্রকন্যা প্রতিভা দেবী হলেন সরস্বতী। লক্ষ্মী সাজলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে। এবং ডাকাতের দলে থাকলেন সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, অক্ষয় মজুমদার, কেদারনাথ মজুমদার। এই নাটক প্রচুর খ্যাতি লাভ করলো। কলকাতার সংবাদপত্র জুড়ে এই নাটকের প্রশংসা ছাপলো। বাইরের লোকেদের সামনে এই প্রথমবার অভিনয় করলেন ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা। সেই দিন দর্শক আসনে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা। বাল্মীকি প্রতিভা শেষ হতেই পরিবারের সকল সদস্যের মন খারাপ। ওরা সকলেই তো নাটক পাগল। এবার চাই নতুন একটি নাটক। রবীন্দ্রনাথ আবার লিখে ফেললেন নতুন নাটক 'মায়ার খেলা'। লেখা শেষ হতেই শুরু হল রিহার্সাল। এরপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ একের পর এক নতুন নাটক লিখলেন। তার পাশাপাশি চলতে থাকলো মহড়া। আর তারপর অভিনয়। রবীন্দ্রনাথের রাজা রানীতে মৃণালিনী চরিত্রে অভিনয় করলেন নারায়ণী। এই ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের নাটকের ইতিকথা।