সঠিক শিক্ষাদান সন্ন্যাস গ্রহণের মতোই মনের দীনতা মুক্তির পথ দেখায়

সময়টা ১৯১৯। য়ুগোশ্লোভিয়ার ছোট্ট একটি শহর। সেখানে একটি পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্যের অকাল প্রয়াণে পরিবারের উপর নেমে আসে দারিদ্রের করাল ছায়া। সেই পরিবারের ছোট্ট আট বছরের মেয়েটি একদিন দেখলো তার মা শহরের সকল অভুক্ত মানুষদের ডেকে খাওয়াচ্ছে। স্বভাবতই মেয়েটির জিজ্ঞাসু চোখ জুড়ে প্রশ্নমালা। মা শেখালেন মেয়েকে "সকলের সঙ্গে ভাগ না করে নিজে এক গ্রাস খাবারও খাবে না কখনো, আর জানবে এরা সকলেই আমাদের আপনজন”।মেয়েটি তার মায়ের সেই শিক্ষা আজীবন ভোলেনি। মা ড্রানার সেই শিক্ষাকে নিজের মধ্যে সযত্নে লালন করে অ্যাগনেস হয়ে উঠেছিলেন সেন্ট টেরেসা। সকলের প্রিয় মাদার টেরেসা।

মাদার টেরেসা শান্তির প্রতীক। সমাজ-সংস্কারক। তাঁর স্নিগ্ধ উপস্থিতিতে যন্ত্রণামুক্ত হত মানুষ। ছোটবেলা থেকে স্থানীয় চার্চে প্রার্থনা সংগীত গাইতে ভালবাসতেন অ্যাগনেস। তাঁর কণ্ঠস্বরে মোহমুগ্ধ মানুষও যেন অন্য জগতে পৌঁছে যেত। বারো বছর বয়সেই তিনি শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর অন্তরের ডাক। "কল উইদিন অ্যা কল"। আঠারো বছর বয়সে আয়ারল্যান্ড ত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছিলেন ডাবলিনে। সিস্টার্স অফ লোরেটোতে কাজ করার লক্ষ্যে। এক সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিয়েছিলেন। মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেখানেই সিস্টার মেরি টেরেসার জন্ম। অ্যাগনেসএর মধ্যে লালিত হতে থাকা সাধ্বী সিস্টার টেরেসা সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার শুরু করেন ওখান থেকেই। ১৯২৯ সালে পরিবার-পরিজনদের ছেড়ে দার্জিলিং পাড়ি দেন তিনি। ১৯৩১ সালে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন সেবাব্রতী হওয়ার। ওই বছরই তিনি পূর্ব কলকাতায় সেন্ট মেরি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। মানুষের সেবা করার ইচ্ছাই প্রকৃত শিক্ষা। এমনটা নিজেও মনে করতেন আর ছাত্রীদেরও তাই শিখিয়েছিলেন। ছাত্রীদের ইতিহাস ও ভূগোল পড়ানোর পাশাপাশি জীবনের পাঠ পড়াতেন। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তাদের মধ্যে বপণ করেছিলেন সেবা ধর্মের বীজ। প্রায় ১৫ বছর শিক্ষকতা করেছিলেন সেখানে। ছাত্রীরা বারবার প্রশ্ন করলেও কখনো বিব্রত হন নি। তাঁর স্নেহছায়ায় ছাত্রীরাও প্রশান্তি অনুভব করতেন। ১৯৩৭ সালে লোরেটোর নিয়মানুযায়ী আবার শপথ গ্রহণ করলেন। তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হলো তাঁর অন্তরের প্রতিচ্ছবি। মাদার। সেন্ট টেরেসা থেকে মাদার টেরেসা। ১৯৪৪ সালে সকলের প্রিয় শিক্ষিকা যোগদান করলেন ওই স্কুলেরই প্রিন্সিপাল হিসেবে। তাঁর শিক্ষকতার গণ্ডি শুধু চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি জীবনকে পাঠ করতেন নিজেও, আর সেটাই সঞ্চারিত করতেন প্রিয় ছাত্রীদের মধ্যে। প্রভু যীশুর পাদপদ্মে জীবন সমর্পণের শিক্ষাদান করতেন। তাঁর প্রার্থনায় লিখেছিলেন "আমার প্রিয় ছাত্রীদের জীবন আলোকিত করার শক্তি দাও প্রভু, যাতে তাদের জীবন পথও ওদের তোমার কাছে পৌঁছে দেয়"।

সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে কলকাতায় হানা দেয় দুর্ভিক্ষ। মাদার বুঝতে পারেন তাঁর প্রকৃত শিক্ষাদান প্রয়োগের সময় এসেছে। দুঃখ , দারিদ্র , যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষকে সেবা ও ভালবাসার বাঁধনে আবদ্ধ করতে কলকাতার পথে নামেন তিনি। অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে সেবায় ব্রতী হন। এই দীপ্তিময় মানুষটি নিজের শেষ জীবনে বিশ্বাসহীনতার যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়েছেন। একটি চিঠিতে লিখেছিলেন "আমি অনেকদিন ধরে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছিনা, ভালোবাসা হীনতায় মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, এটা আমায়ও যন্ত্রণা দিচ্ছে, তাঁরা যেন আত্মশুদ্ধির শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়"। ১৯৯৭ সালে আজকের দিনেই পৃথিবী হারিয়েছিল এই জাজ্জ্বল্যমান শিক্ষিকাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...