ইংরেজ সরকারের অত্যাচারে প্রাণ দিয়েছিলেন কাদম্বিনীকন্যা জ্যোতির্ময়ী

১৯৪৫ সালের ২১শে নভেম্বর। আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দীদের মুক্তির দাবিতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেসের শোভাযাত্রা চলছিল। স্বাধীনতার কথা তখন চলছে। তবুও ইংরেজ শাসন যেন শেষ হয় না। বন্দী মুক্তির ক্ষেত্রে বারবার গড়িমসি করতে থাকে ইংরেজ সরকার। তাই বিভিন্ন সংগঠনের লড়াই চলছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে।

১৯৪৪ সালের ২১শে নভেম্বর শোভাযাত্রা আয়োজন করেছিল দুটি সংগঠন। মূল লক্ষ্য ছিল বন্দীদের মুক্তির দাবি। ইংরেজরা জানে এই দেশ তাদের ছাড়তে হবে। তবুও লড়াইয়ের বিরোধিতা করায় বদ্ধপরিকর ছিল তারা। এই দুটি সংগঠনের শোভাযাত্রার ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায় ইংরেজ পুলিশরা। অনেক কিশোর-কিশোরী এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এক কিশোর ছাত্র। রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। আহত হয় বহু ছাত্র। চরম বিশৃঙ্খলার অবস্থা তখন। উচ্চস্তরের নেতা-নেত্রীরা প্রতিবাদের কর্মসূচির আয়োজন করছেন। কেউ আবার আহতদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করছেন। এদের মধ্যে  এক নারী তখন বসেছিলেন থ হয়ে। ওই কিশোরের মৃতদেহ আগলে সেদিন বসেছিলেন সেই নারী। সারারাত ধরে সেই নিথর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। দেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। ক’দিন বাদে হয়তো সেই কাঙ্খিত স্বাধীনতা আসবে, এমন সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছিল। সেই মেয়েটির বারবার মনে হচ্ছিল একটা কথা। সেদিনের সেই মৃত কিশোর রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাধীন দেশ দেখতে পেল না। দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনে যে কারিগর হতে পারত, পুলিশের অন্যায়-অত্যাচারে সে প্রাণ হারালো। অকালে ঝরে গেল একটা ফুলের কুঁড়ি। অনেক নেতা-নেত্রীরা সেই মহিলাকে বারবার অনুরোধ করলেও কিছুতেই সে মৃত কিশোরকে ছেড়ে যায়নি। ‌ পরের দিন ওই কিশোরের মৃতদেহ নিয়ে একটি শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়েছিল। এই শোভাযাত্রার সময়ে একটি মিলিটারি ট্রাক ধাক্কা দেয় শহীদ রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শববাহী গাড়িকে। গাড়ির একদম সামনেই বসেছিলেন সেই মৃতদেহ আগলে বসে থাকা মেয়েটি। মাথায় চোট লাগে মেয়েটির। হাসপাতালে লড়াই করেছিলেন জীবনের সঙ্গে। বেশিদিন লড়তে হয়নি। হাসপাতালেই মারা গিয়েছিলেন তিনি। এই সাহসী নারী জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর কন্যা।

জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর জন্ম ১৮৮৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি। কলকাতার ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের বাড়িতে জন্ম হয় তাঁর। বাবা দ্বারকনাথ গাঙ্গুলী ও মা কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ছোট থেকেই মেয়েকে শিখিয়েছিলেন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করা। মেয়েও বাবা-মার মতই একরোখা ছিলেন। কাজেই সমর্পণ করেছেন জীবন। কাদম্বিনীর মতোই আধুনিক মানসিকতার অধিকারিণী ছিলেন জ্যোতির্ময়ী।

ব্রাহ্ম-বালিকা শিক্ষালয়ে প্রথম শিক্ষা শুরু হয়েছিল জ্যোতির্ময়ীর। মা কাদম্বিনী বেথুন কলেজকে নারী শিক্ষার পীঠস্থান হিসেবে স্থাপিত করেছিলেন। সেই বেথুন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী। ১৯০৯ সালে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মূলত শিক্ষকতা করতেন জ্যোতির্ময়ী। বহু জায়গায় শিক্ষকতা করেছেন। বেথুন স্কুল, কটক র্্যাভেন্স কলেজ , জলন্ধর-এর আর্য কন্যা মহাবিদ্যালয়,  আশুতোষ কলেজ ইত্যাদি জায়গায়। সেবার ব্রত প্রথম মাথায় ঢুকিয়েছিলেন মা কাদম্বিনী নিজেই। অল্প বয়সেই অধ্যাপনা ছেড়ে জ্যোতির্ময়ী যোগ দিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। ১৯১৭ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি অ্যানি  বেসান্তের  সভাপতিত্বে যে অধিবেশন হয়েছিল তাতে নারী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী তৈরি করেছিলেন জ্যোতির্ময়ী। প্রত্যেক ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য পথে নেমেছিলেন জ্যোতির্ময় গাঙ্গুলী। কামিনী রায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'বঙ্গীয় নারী সমাজ' সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খুব কম সময়ই সকলের মন জয় করেছিলেন তিনি।

তমলুকের নরঘাটে আইনের ১৪৪ ধারা অমান্য করে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত হয়েছিল তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য। জ্যোতির্ময়ী স্নেহপ্রবণ মানুষ ছিলেন। নিম্নবর্গের মানুষের জন্য বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন তিনি। তাইতো একবার তাঁর বক্তৃতার সময় পুলিশ এলে, জ্যোতির্ময়ীকে আগলে রেখেছিলেন কৃষক-রমণীরা।‌

জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী নিজেও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন। একবার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতার গড়ের মাঠে এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। তখন ১৯৩১ সাল। কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট-এর নির্দেশে অশ্বারোহী সার্জেন্টরা সুভাষচন্দ্রকে ঘিরে ফেলেছিল সেদিন। তারা ব্যাটন দিয়ে সুভাষচন্দ্রকে আঘাত করার জন্য এগিয়ে যায়। ‌ সেই সময় সুভাষচন্দ্রকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আঘাত থেকে রক্ষা করেছিলেন জ্যোতির্ময়ী। যথারীতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।

শিক্ষাদানের প্রথাগত পথ ছেড়ে এলেও জ্যোতির্ময়ী বিশ্বাস করতেন শিক্ষা সংস্কারে। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়াই করতেন তিনি। বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষদের জন্য 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি'র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আজীবন তিনি সেবা করে গেছেন লড়াই দিয়ে। ঠিক মায়ের মতোই।

কেউ বলে তাঁর মৃত্যু দুর্ঘটনা। কেউ বলেন ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। তাঁর দাদা প্রভাতচন্দ্র গাঙ্গুলী নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বোনের এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে মানতে অস্বীকার করেছেন।

লীলা মজুমদার জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী সম্বন্ধে লিখেছিলেন ''জংলুমামাদের এক বোনের নাম ছিল জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী। আমরা ডাকতাম চামি-মাসি। বিয়ে থা করেননি, নিজের মায়ের মতোই লম্বা, দশাসই চেহারা। নিষ্ঠাবতী দেশকর্মী। ইংরেজ সরকারের অত্যাচারে শেষটা প্রাণ দিয়েছিলেন।''

এমন মহীয়সী মহিলার স্মৃতি ইতিহাসের পাতায় আবছা। তেমনভাবে তাঁর কথা জানার পরিধিতে আসে না। এই অখ্যাত, অনামী মানুষদের লড়াইয়ের ফসল আজকের স্বাধীনতা।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...