চিকিৎসা করতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হন ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

বিলেত থেকে ফিরেছেন এক মা। বিলেতে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন তিনি। পাঠিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। ডাক্তারিতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যই মূলত যাওয়া। সেই মেয়ে তখন সন্তানদের মা। সন্তানদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁদের দিদিমা। ডাক্তারিতে উচ্চশিক্ষা লাভ করে মা ছুটে আসছেন সন্তানদের কাছে। তাঁর মন তখন আকুলি-বিকুলি করছে। কিন্তু যে কয়েকটা বছর মায়ের গন্ধ পায়নি সন্তানেরা, সবচেয়ে ছোট্টটি ভুলে গেছে মায়ের সেই গন্ধ। কিছুতেই সে বিলেতফেরত ডাক্তার মায়ের কোলে যাবে না। নানা সান্ত্বনা, আদরে মা ভরিয়ে দিচ্ছে তাঁর সন্তানদের। তবুও ছোট ছেলেটি কিছুতেই যেতে চাইছে না মায়ের কাছে। বিলেত ফেরত সেই মা সারাদিন কেঁদেছিলেন সেদিন। নিজের সাফল্য তখন মাতৃস্নেহের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই মা আবার পরের দিন ছুটে গেছেন ডাক্তারি করতে। অন্তঃপুরবাসিনী কোন মহিলাকে বাঁচিয়েছেন। ফিরে এসে পরিস্কার হয়ে নিজের সন্তানের কাছে গেছেন। মাতৃস্নেহে ভরিয়ে দিয়েছেন তাদের। এমনই চমৎকার, আশ্চর্য মহিলা ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক ডক্টর কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।

''দিস ইয়ং লেডি, মিসেস গাঙ্গুলী, ম্যারেড! আফটার শি মেড আপ হার মাইন্ড টু বিকাম এ ডক্টর! অ্যান্ড হ্যাজ হ্যাড ওয়ান, ইফ নট টু চিলড্রেন সিনস। বাট শি‌ ওয়াজ আবসেন্ট অনলি থার্টিন ডেজ ফর হার লাইং-ইন! অ্যান্ড ডিড নট মিস, আই বিলিভ অ্যা সিঙ্গেল লেকচার"

কথাটি বলেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সম্বন্ধে এ কথা বলেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

কাদম্বিনী বসুর জন্ম ১৮৬১ সালের ১৮ জুলাই। বিহারের ভাগলপুরের জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ‌ তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্ম। নারীশিক্ষার প্রসারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন তাঁর বাবা। ছোট থেকেই কাদম্বিনীর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। নানান বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন। কৌতুহলী ছিলেন। বাবা বুঝতে পারতেন এ মেয়ে অন্তঃপুরে থাকার জন্যে পৃথিবীতে আসেনি। তিনি নিজেও নারীশিক্ষায় অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। তাই মেয়েকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। উচ্চশিক্ষার জন্য কাদম্বিনী ভর্তি হলেন কলকাতার হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে। এরপর কাদম্বিনী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার কথা ভাবলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথা অনুযায়ী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী লড়াই করে অবশেষে নারীদের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার অনুমতি যোগাড় করেন। ১৮৭৮ সালে কাদম্বিনী বসু প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন বেথুন কলেজে। এমনটাই শোনা যায় কাদম্বিনী বসুর জন্যই বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করার কথা ভেবেছিলেন সরকার এবং শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। একজন ছাত্রী ও একজন অধ্যাপিকা নিয়ে শুরু হয়েছিল বেথুন কলেজ। এখান থেকে ১৮৮২ সালে গ্রাজুয়েট হয়েছিলেন কাদম্বিনী।

এর মধ্যেই দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী বিয়ে করেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে। কাদম্বিনী ছিলেন বাল্যবিধবা। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী তখন বিপত্নীক ছিলেন। উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। সংরক্ষণশীল সমাজের বাইরের মানুষ। তিনি কাদম্বিনীকে পড়তে পাঠান বিলেতে। তিনিই প্রথমে কাদম্বিনীকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে ডাক্তারি পরীক্ষা পাস করে কাদম্বিনী মড়াকাটা, ধাত্রীবিদ্যা সব শিখেছিলেন। অন্তিম পরীক্ষাও পাশ করেন তিনি। কিন্তু সেই সময় কেউই তাঁকে স্নাতক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

কাদম্বিনী যে সময় বিলেতে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন তখন কোন মহিলাও বিলেতে ডাক্তারি পাস করেননি। সন্তান হওয়ার পরেই তাঁর স্বামী তাঁকে বিলেতে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিল।

পরিবার, সংসার, মাতৃস্নেহ সবকিছু সামলে ও সারাজীবন ডাক্তারি করেছেন এই আশ্চর্য মহিলা। তবে তাঁকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তাঁর স্বামী। দীর্ঘদিন তিনি নেপালের রাজ অন্তঃপুরের গৃহ চিকিৎসক ছিলেন। সেখান থেকে চলে আসার পর তাঁরা সম্মানের সঙ্গে তাঁকে বিদায় জানান। নেপালে সম্মান পেলেও নিজের দেশে অনেক সময়ই অসম্মানের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মনোবল হারাননি একফোঁটাও।

একবার কোন বড়লোকের বাড়িতে কারোর প্রথম সন্তান হবার সময় কিছু সমস্যা হয়েছিল। ধাত্রীরা প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কাদম্বিনী তখন মা ও সন্তানের প্রাণ বাঁচান। তারপর স্নান করে এসে দেখেন সেই বাড়ির উঠোনের পাশের বারান্দায় তাঁর খাবার জায়গা দেওয়া হয়েছে। বাড়ির দাস-দাসীরা ওখানেই খাচ্ছেন। কাদম্বিনীও সেখানে খেতে বসলেন। খাওয়া শেষ করার পর সেই বাড়ি থেকে বলে পাঠানো হলো প্রত্যেকেই যেন নিজের বাসন নিজে মেজে নেন। এমন অসম্মান, বঞ্চনার পরও দেশের সেবা করে গেছেন। নিজের পেশার মাধ্যমে কাদম্বিনী এই দেশের মেয়েদের সেবা করেছেন নিজের অন্তর দিয়ে।

এতটাই ইতিবাচক মানুষ ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী যে ঘোড়ার গাড়ি করে যখন তিনি রোগী দেখতে যেতেন সেই সময়ও উল, কাঁটা দিয়ে অপূর্ব ক্রুশের কাজ করতেন। নিজের জীবনের কোনো মুহূর্তই নষ্ট করেননি নেতিবাচক কথা ভেবে।

এদিকে রক্ষণশীল সমাজ কিন্তু তাঁকে যথেষ্ট হেনস্থা করেছে। তাঁর ডাক্তারী পড়া নিয়ে বঙ্গবাসী পত্রিকা তাঁকে হেয় করে একটি কার্টুন প্রকাশ করেছিল যেখানে দেখানো হয়েছিল কাদম্বিনী তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর নাকে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কুরুচিকর মন্তব্য করা হয়েছিল কাদম্বিনীর সম্বন্ধে। কাদম্বিনী কিন্তু থেমে যাননি, হার মানেননি। আদালতে তিনি ও তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী অভিযোগ জানিয়েছিলেন বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ চন্দ্র পালের বিরুদ্ধে। তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন ডাক্তার নীলরতন সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রীর মত মানুষরা।

এ তো গেল ডাক্তারি ক্ষেত্রের বাইরের মানুষদের কথা। মেডিকেল কলেজে শিক্ষকরাও কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর ডাক্তারি পড়া নিয়ে বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুটি পত্রে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে তাঁর আর এমবি পরীক্ষা পাস করা হয়নি। পরিবর্তে গ্র্যাজুয়েট অফ দ্যা মেডিকেল কলেজ অফ বেঙ্গল বা জিএমসিবি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। পরবর্তীকালে ইডেন হাসপাতালে কাজের সুযোগ পেলেও তিনি নার্স হয়ে কাজ করতেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁকে কোন সম্মান দেওয়া হতো না। তবুও হেরে যাননি কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।

এর পরেই দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী তাকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়ার জন্য। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন তিনি স্কলার্শিপ পেতেন মাসে কুড়ি টাকা। লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসিক তিনশ টাকা বেতনের বিনিময়ে কাজ করেছেন। নিজের পেশাকে সেবা মনে করেই কাজ করেছিলেন।

১৮৮৯ সালে বোম্বেতে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে নারী প্রতিনিধিদের মধ্যে কাদম্বিনী ছিলেন অন্যতম। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। স্বামীর সহযোগিতা যেমনভাবে পেয়েছেন নিজের কাজে, তেমনভাবেই স্বামীকে সঙ্গ দিয়েছেন তাঁর কাজে। স্বামীর সঙ্গে চা বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। নারী শ্রমিকদের নিয়েও কাজ করেছিলেন তিনি।

তাঁর জীবন ঠিক যেন রূপকথার মত ছিল। সেবা করেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। অথচ খুব সহজেই মিশে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। কাদম্বিনীর সৎ মেয়ে বিধুমুখী ছিলেন বিখ্যাত লেখিকা লীলা মজুমদারের জেঠিমা। লীলা মজুমদার লিখেছেন ''তার জীবনটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার চাইতে সামান্য বড় ছিলেন, দেখে মনে হতো অনেক ছোট। মস্ত দশাশই চেহারা, ফুট ফুট করত গায়ের রং, থান পরতো, এত বয়সেও রূপ চাপা পড়তো না, তবে কেমন যেন একটু কড়া ধরনের ভাব। আমরা দূর থেকে দেখতাম।"

১৯২৩ সালের ৩রা অক্টোবর মারা যান কাদম্বিনী। তাঁর জীবন নারীর লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...