রাতে স্বপ্ন বলতে ছিল খেলার স্বপ্ন। ওটুকুই আলো ছিল ছোটবেলা থেকে। যদিও মেয়েটার ইচ্ছেটুকুই আলোর বিন্দুর মত জেগে ছিল। বাকি পথটা ছিল পাথরে ভরা। কঠিন। মেয়েটা স্বপ্ন দেখতে জানত। স্বপ্নপূরণের আশা করেনি। কিন্তু বট গাছের শিকড় যেমন মাটির গভীরে প্রোথিত থাকে, তেমনই মনের গভীরে খেলার স্বপ্নটা বোনা ছিল। সেই স্বপ্নকে পাথেয় করেই বাকি পথটা তৈরী করার চেষ্টা করছিল মেয়েটা। খো-খো খেলাকে সাধনার মত করে আঁকড়ে থাকা বাকি কাজটা করে দেয়। এমনই লড়াকু, প্রতিভাবান খো-খো খেলোয়াড় প্রীতি মন্ডল।
বারাসাতের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম প্রীতির। বাবা ছেড়ে গেছে কবে তা মনে করতে পারে না। প্রীতির ভাই তখন আরো ছোট। দুই সন্তানকে নিয়ে থাকার জায়গা পর্যন্ত ছিল না প্রীতির মায়ের। প্রীতি তখন নেহাত কিশোরী।
কিছু সহৃদয় মানুষের সহায়তায় অবশেষে ঠাঁই হয় বারাসাত স্টেশনের কাছে। কিন্তু ব্যবস্থা ছিল না অন্নসংস্থানের। একবেলা কোনমতে খেয়ে থাকত সকলে। প্রীতির পড়াশোনা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল।
প্রীতির মা হাল ছাড়ার মানুষ ছিলেন না। টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন বারাসাত স্টেশনে। কিছুতেই পসার জমছিল না। তখন তিনি ট্রেনে উঠে সাজগোজের জিনিস বিক্রি করা শুরু করেন। একটু অবস্থা ফেরে।
কিন্তু দুই সন্তানের পড়াশোনা ও ভরণপোষণ কঠিন হচ্ছিল। মাকে এই অবস্থায় দেখে প্রীতির জেদ আরও বাড়ে। জীবনে কিছু একটা করে দেখাতে হবে এই ভাবনা গেঁথে যায় মাথায়।
তবে পথ বেছে নেওয়া কঠিন ছিল। প্রীতি দৌড়তে ভালোবাসতো। ইচ্ছে ছিল অ্যাথলিট হওয়ার। তবে পাল্টে যায় ইচ্ছেগুলো।
একদিন প্রীতির পাড়ায় খো-খো খেলার একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। প্রীতির স্কুলের এক বান্ধবী তাকে নিয়ে যায় সেই প্রতিযোগিতায়। প্রথম দিকে প্রীতির যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতাটি থেকে বড় স্তরে সুযোগ পাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। আবার স্বপ্ন! মায়ের ইচ্ছে পূরণের! নিজের ইচ্ছে পূরণের! সব থেকে জরুরী যেটা, নিজেদের অবস্থা বদলের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করার সুযোগ। তাই খো-খো খেলার প্রতিযোগিতাটিতে অংশগ্রহণ করে প্রীতি। যথারীতি বিশেষভাবে সফল হয়।
প্রীতি ভালোবেসে ফেলে এই খো-খো খেলাকে। আঁকড়ে ধরে সাধনার মত করে। খো-খো খেলার বিভিন্ন স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
এই ক্ষেত্রে পরের দিকে প্রীতির কোচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সমীর বিশ্বাস প্রীতি মণ্ডলের কোচ। প্রথমবার প্রীতি যখন কোচের কাছে খেলা শিখতে যায়, তখন তার জার্সি ছিল না। এই কোচ তাকে খেলা শেখাতে অস্বীকার করেন। এরপর বিভিন্ন স্তরের খো-খো প্রতিযোগিতায় প্রীতি নিজেকে প্রমাণ করে। সেই কোচ নিজে এগিয়ে এসে প্রীতিকে খেলা শেখানোর প্রস্তাব দেন। এবার প্রীতি অস্বীকার করে শিখতে। সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল নিজের জার্সি না কিনে সে কিছুতেই খেলা শেখার ময়দানে নামবে না।
প্রীতির মা ট্রেনে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন তখনও। ট্রেনের হুইসেল বাজলেই প্রীতি দৌড়ত। দিনের প্রথম রোজগারটা মা ট্রেন থেকে ছুড়ে দিতেন মেয়ের দিকে। একবার ৫০ টাকা দিয়েছিল মা এভাবেই। সেদিন ৫০ টাকাতেই জার্সি কিনেছিল প্রীতি। প্রথমবার নিজের জার্সি। তখন কোচের কাছে আবার যায় প্রীতি। নিজের জার্সি নিয়ে খেলা শিখতে। কোচ আনন্দে আশীর্বাদ করেন প্রীতিকে। এখনো এই কোচের কাছেই প্রশিক্ষণ নেয় প্রীতি মন্ডল।
এরপর খো-খো খেলাকে আঁকড়ে ধরে প্রীতি নিজের মতো করে এগিয়ে চলেছে। জাতীয় স্তরে অন্যান্য রাজ্যে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রীতি প্রথম মহিলা খো-খো খেলোয়াড় যে ভারত সরকারের খেলো ইন্ডিয়া স্কিমের জন্য নির্বাচিত হয়।
এই খেলো ইন্ডিয়া স্কিমের টাকায় প্রীতি এখন সংসার চালায়। ভাইয়ের পড়াশোনা সামলায়। মা মেয়েকে সাহায্য করার জন্য এখনো ট্রেনে জিনিসপত্র বিক্রি করে।
প্রীতি স্বপ্ন দেখে। ট্রেনের পাশে একটা ছোট্ট ভাড়া ঘরে থাকে তারা। কিন্তু ওরা স্বপ্ন দেখে দূর পথের। মায়ের জন্য একটা বাড়ি করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে প্রীতি। আরো একটা স্বপ্ন ওর চোখে এঁকে দিয়েছে খো-খো খেলা। ভারতের হয়ে সরাসরি আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতায় খেলা। প্রীতির জীবনে আজও আলো বলতে খেলার স্বপ্ন। আর নিজের মাকে একটা সম্মানজনক জীবন দেওয়ার স্বপ্ন। প্রীতি তার স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলেছে একটু একটু করে। কঠিন পাথুরে পথ প্রীতিকে থামাতে পারিনি। বরং আগামী দিনের লড়াইয়ের জন্য আরো ভালোভাবে প্রস্তুত করেছে।