১২৯৯ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬২৫ বছর এশিয়া ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেছে ওসমানীয় শাসকগণ। এই দীর্ঘ সময়ে ৩৭জন ওসমানীয় ক্ষমতায় এসেছেন। ১৫ শতকের মাঝামাঝি বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খিলাফত ধ্বংস হয়ে গেলে ওসমানী খিলাফত আরো শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য এই ওসমানী খলিফাদের হাতেই ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু এই ঐতিহ্যশালী ৫২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলো বর্তমানে ৪৯টি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আমরা এই লেখায় এই অটোমান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধান চালিকা শক্তি হওয়ার প্রেক্ষাপট ও পরিণতি জানবো।
ওসমানিয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম ওসমানের পিতা 'কাই' গোত্রের প্রধান এরতুঘ্রাল গাজী। 'কাই' গোত্র মধ্য এশিয়ার চেঙ্গিজ খানের আগ্রাসনের শিকার হয়ে আনাতোলিয়ায় আসে। বর্তমানে তুরস্কের ইউরোপ অংশ থ্রাস ও এশিয়া অংশ আনাতোলিয়া নামে পরিচিত। এলতুঘ্রাল গাজী রোম শাসকের সমর্থনে উঃ পঃ আনাতোলিয়া শাসন শুরু করে। মোঙ্গল আক্রমনে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য দুর্বল হলে গাজী বাইজান্টাইন অভিযান চালান। এক অভিযানে তিনি সোগুত জয় করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। ১২৫৮ এ সোগুতে জন্ম গ্রহণ করেন ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ওসমান। ১২৯৯ এ গাজীর মৃত্যুর পর প্রথম ওসমান 'বে' (বেগ বা প্রধান) নিযুক্ত হন। 'বে’ বা ‘বেগ’ শাসিত রাজ্য 'বেইলিক' নাম পরিচিত। 'বে'র প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ওসমান আনাতোলিয়া বেইলিকের প্রধান ছিলেন। উঃ পঃ আনাতোলিয়ার এই শক্তি বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১২ শতকে মোঙ্গল আক্রমণে পর্যুদস্ত রোম শাসন ১৪ শতকে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বেইলিকগুলি এই সময় স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং প্রথম ওসমান এই সুযোগে স্বাধীন বেইলিকগুলি জয় করে সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি তুরস্কের অধিকাংশ বেইলিকগুলি করায়ত্ত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সুলতান হন প্রথম ওরহান। তিনি বাকি বেইলিকে করায়ত্ত করে ইউরোপ অগ্রসর হন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম মুরাদ ইউরোপের অনেক এলাকা জয় করেন। এই সময় বলকান অঞ্চল ওসমানী সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হয়।
১৫ শতকে মোঙ্গল শাসক হলাগু খান বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খলিফা ধ্বংস করেন। পরবর্তী ২য় মোহাম্মদ ওসমানীয় সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক ঘোষণা করেন যা ওসমানীয় খিলাফত নাম পরিচিত। তিনি ওসমানী রাজধানী এডিনপোল থেকে কনস্টান্টিনোপলে স্থানান্তরিত করেন যা অধুনা ইস্তাম্বুল। এই সময় থেকেই ইস্তাম্বুল কেন্দ্রিক খিলাফত তুরস্কে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ শতকে বাইজান্টাইনে সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে যে খ্রিস্ট ধর্মের বিকাশ, দ্বিতীয় মোহাম্মদের হাতে তার পতন ঘটে ও কনস্টান্টিনোপল মুসলিম অধীনস্ত হয়। কনস্টান্টিনোপল জয় করে দ্বিতীয় মোহাম্মদ ওসমানী খিলাফতের প্রথম খলিফা হন। চূড়ান্ত ওসমানী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি লাভ করে প্রথম সুলেমানের আমলে। তিনি সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথম সুলেমান ১৫২১ খ্রীষ্টাব্দে বেলগ্রেড জয় করেন। ওসমানীয় ও হাঙ্গেরির যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্য ও দঃ হাঙ্গেরি সুলাইমানের অধীনস্ত হয়। ১৫৪৭ এ হ্যাপসবুর্গ শাসক ফার্দিনান্দ আনুষ্ঠানিক ভাবে তার বশ্যতা স্বীকার করেন। আরব ও আফ্রিকার বিশাল অংশ তার অধীনস্ত হয়। তাঁর সময়ে জ্ঞান- বিজ্ঞান- প্রযুক্তিতে সাফল্য পায়। যা তুর্কি সাম্রাজ্যের 'স্বর্ণযুগ'। ইউরোপের অনেক অঞ্চল তুর্কি শাসনভুক্ত হয়। ন্যায় বিচার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি 'কানুন-ই সুলেমান’ নামেও পরিচিত ছিলেন। 'শরিয়তি আইন' আক্ষরিক অর্থে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯১৪ পর্যন্ত এই ওসমানী সাম্রাজ্যের বিজয়রথ কার্যকরী থাকে শেষ খলিফা আব্দুল মাজিদের সময় পর্যন্ত। দীর্ঘ ৬০০ বছরের বেশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগস্থল হয়ে ওঠে এই ওসমানী সাম্রাজ্য। সেক্যুলারিজম এই সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করে, সাথে যুক্ত হয় ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। ১৯০৮ এ তরুণ তুর্কি বিপ্লবের পর ২য় সাংবিধানিক যুগ শুরু হয় যা ওসমানী সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি সাধন করে। ১৯২২ এ কামাল পাশা ক্ষমতায় এলে তুর্কি সালতানাদ বিলুপ্তি আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত হয়।
১৯২৩ এ ২৯ শে অক্টোবর তুর্কি গ্রান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। যদিও খিলাফত ছিল এবং নামে খলিফা ছিলেন আব্দুল মাজিদ। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিক খলিফার ও অবলুপ্তি হয় ১৯২৪ এ ৩রা মার্চ। ফলে ৫২ লক্ষ বর্গমাইলের ওসমানী সাম্রাজ্য ৩ লক্ষ বর্গ মাইল এর টার্কিতে পরিণত হয়।