আমরা মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে সকলেই জানি, যে এই শহরটি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব-এর জায়গা। কিন্তু আপনারা অনেকেই হয়ত শোনেননি নশিপুর রাজবাড়ি সম্পর্কে। রাজা দেবী সিংহ এই রাজবংশের পত্তন করেন। নবাবি আমলের অবসানের পর ব্রিটিশ শাসনকালে যে সব ব্যক্তি জমিদারিত্ব লাভ করেছিলেন তাদের অন্যতম রাজা দেবী সিংহ|
১৭৫৬ সালে রাজা দেবী সিংহ পানিপথ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসেন ব্যবসা সংক্রান্ত কারণে....পরে ব্রিটিশদের আনুগত্য পেয়ে ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং সেই কাজ যথেষ্ট ভালোভাবে সম্পন্ন করেন। ধীরে ধীরে এই কাজে রপ্ত হয়ে হেড কালেক্টর হয়ে যান। এইভাবেই তিনি বাংলায় থেকে যান এবং নশিপুর রাজবাড়ি স্থাপন করেন।
পরবর্তীতে রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ বাহাদুর ১৮৬৫ সালে রাজবাড়িটির সম্প্রসারণ ঘটান।
ভাগীরথী নদীর পূর্ব দিকে নশিপুর রাজবাড়ির কাছে এখানে নশিপুর আখড়া রয়েছে। এটি ছিল রামানুজ সম্প্রদায়ের সাধুদের আস্তানা বা আখড়া| সাধুদের মধ্যে যিনি চিরকুমার থাকতেন, তিনিই হতেন সেবাইত। তবে আপনাদের একটা বিষয়ে জানাই, এখানে ঝুলন যাত্রার সময়ে বেশ বড় মেলা হয় এবং যাত্রা পালা হয়।
এই রাজবাড়িটি কালের অতলে তলিয়ে যেতে বসেছিল। বংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রৌঢ় সদস্য সৌরেন্দ্রমোহন সিংহ জানালেন, মন্দির, নাটমন্দির, রাজবাড়ী মিলে মোট আয়তন প্রায় ২০ বিঘা। সেখানে ৭০টি ঘর সম্বলিত অন্দরমহল ছিল। কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক অনটনে সংস্কার করা যায়নি। তার ফলে ওই বিশাল অন্দরমহল আজ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। ওই পরিণতি থেকে অবশিষ্ট রাজপ্রাসাদ ও মন্দির বাঁচাতে নশিপুরের পাঁচ জন যুবককে সম্পত্তির শতকরা ৮০ ভাগ ৬০ বছর লিজে দেওয়া হয়েছে। বাকি ২০ ভাগ রাজপরিবারের হাতেই রয়েছে। অর্থাৎ ওই পাঁচ জন এবং রাজপরিবারের সদস্য মিলে যৌথভাবে রাজবাড়ী সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষণ করার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সঙ্গে রয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার বিশিষ্ট কারু ও চিত্রশিল্পী পঞ্চানন কর্মকার। শুধুমাত্র ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাই নয়, লালবাগের পর্যটন শিল্প সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাঁরা। কয়েক মাসের চেষ্টায় ভাঙাচোরা রাজপ্রাসাদের ভোল পাল্টে ফেলেছেন এবং সংস্কারের ফলে জরাজীর্ন দশা কাটিয়ে উঠে প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন নশিপুর রাজবাড়িটি এখন দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে।
পর্যটকদের উদ্দেশ্যে রাজবাড়ী ও মন্দির খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্থায়ী আর্ট গ্যালারি করার জন্য বিনাভাড়ায় পঞ্চাননবাবুকে দু'টি ঘর দেওয়া হয়েছে। চক, মাটি, এলুমিনিয়ামের তার ও টুকড়ো, কাগজের মণ্ডের তৈরী বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী ছাড়াও ওই গ্যালারিতে রয়েছে প্যাস্টেল, অয়েল পেইন্টিং ও স্কেচের প্রায় ৫০টি চিত্রকর্ম। খুলে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক নাটমন্দির সহ আট বিঘা এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হনুমান মন্দির, কালী মন্দির ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ। রয়েছে ডাইনিং রুমের দেওয়ালের পাশে মেঝের ওপর মেহগনি কাঠের কারুকার্যময় ৮ ফুট উচ্চতার 'গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক'। আরও আছে নিমকাঠের তৈরী দুশো বছরের প্রাচীন বিশালাকৃতির দেবদেবীর কয়েকডজন মূর্তি, ৬ফুট উচ্চতার কাঠের তৈরী রামগরুড়ের বিস্তৃত দু'টি দানার ওপর অধিষ্ঠিত লক্ষ্মীনারায়ণের যুগলমূর্তী। মুর্শিদাবাদ পুরসভার ১৪ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত নশিপুর রাজবাড়িটি বর্তমান পর্যটন শিল্পে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে।