কলকাত্তেওয়ালী কালীর শহর এই কলকাতা, এই শহর কলকাতার নামের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কালীক্ষেত্র কালীঘাটের নাম। অনেকেই মনে করেন কলকাতার নামকরণ হয়েছে কালিঘাটের থেকেই, সূর্যকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কালীক্ষেত্র দ্বীপিকা’ যা বর্তমানে ‘কালীঘাটের পুরাতত্ব’ নাম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তা এই বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করে। ভাগীরথীর প্রাচীন খাত যা আদিগঙ্গা নাম পরিচিত তারই ঘাটের ওপর অবস্থিত মহাতীর্থ কালিঘাট। আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরটির নির্মান করেন হাটখোলা দত্তবাড়ির কালীপ্রসাদ দত্ত আর বড়িশা সাবর্ণ রায়চোধুরী পরিবারের সন্তোষ রায়চৌধুরী। পঞ্চদশ শতকের মনসা ভাসানের গান অথবা সপ্তদশ শতকের কবিকঙ্কন মুকুন্দ বিরচিত চন্ডিমঙ্গল বা অভয়ামঙ্গলেও কালিঘাটের কথা উল্লিখিত হয়েছে। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এই মন্দিরটির বয়সের প্রাচীনত্ব আরও বেশি কারণ পূর্বে এটি ছিল পাতা দিয়ে তৈরী,খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতকে মহারাজা মানসিংহ প্রথমবারের জন্য এখানে একটি স্থায়ী মন্দিরয়ের স্থাপনা করেছিলেন। দশমহাবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ দেবী কালীর বর্তমান রূপকল্পনা বাংলায় ষোড়শ শতাব্দীর আগে খুব একটি লক্ষ্য করা যায়না,বঙ্গীয় পুরান ‘দেবী ভাগবত’ এর সময়কাল এবং তার রচনার বিষয়বস্তুও এই মত কে কিঞ্চিৎ সমর্থন করে। এই দেবী ভাগবত রচনার কিছুকাল পরেই বাংলা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ‘দশমহাবিদ্যা’ লোকসাহিত্য এবং মঙ্গলকাব্য রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দক্ষ ও সতীর উপাখ্যান, সতীর দেহত্যাগ এবং সতীপীঠ আর শক্তিপীঠ তৈরী হওয়ার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা। একান্ন পীঠ বলে যে তীর্থগুলি পরিচিত তার অধিকাংশই অতীতে ছিল বজ্রযানী বৌদ্ধদের সাধনক্ষেত্র এমনটাই মনে করেন অনেক গবেষকেরা কারণ আদিমধ্যযুগ এবং মধ্যযুগে বাংলা হয়ে উঠেছিল বজ্রযানীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। এই পীঠগুলির প্রায় প্রত্যেকটিতেই দেবীমূর্তি শিলাস্বরূপা, এবং কালীঘাটও তার ব্যতিক্রম নয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দক্ষ শিব বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে একটি শিববহির্ভূত যজ্ঞের আয়োজন করেন, শিবপত্নী সতী পিতা দক্ষ-এর যজ্ঞে উপস্থিত হলে দক্ষ সতীর সামনেই শিবনিন্দা করতে থাকেন, পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করেন। সতীর দেহত্যাগের বার্তা পেয়ে শিব ক্রোধান্বিত হন এবং সতীর প্রাণহীন দেহ কাঁধে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকেন। ক্রূদ্ধ শিব কে শান্ত করার উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চালনা করে সতীর দেহ খণ্ডিত করে দেন, সেই খণ্ডিত দেহের বিভিন্ন অংশ যেখানে যেখানে পতিত হয় সেখানেই একটি করে শক্তিপীঠের স্থাপনা হয় এবং সেই খণ্ডিত দেহের অংশ প্রস্তর খন্ডে পরিণত হয়। পিঠমালা তন্ত্রমত অনুযায়ী সতীর ডান পায়ের চারখানি আঙ্গুল পতিত হয় এই কালীঘাটে। কালীঘাটের কালীমূর্তিটি নির্মাণ রীতির দিক দিয়ে যে অভিনব সে কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। এইরকম মূর্তি ভূভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই, বর্তমান মূর্তির রূপকল্পনা করেছিলেন ব্রহ্মানন্দ গিরি এবং আত্মারাম গিরি নামক দুই সাধক। মন্দিরের অদূরেই অবস্থান করেন এই পিঠের রক্ষক ভৈরব নকুলেশ্বর। দাবি করা হয় সতী দেবীর প্রস্তরীভূত পদপল্লব এখানেই সংরক্ষণ করে রাখা আছে। এই মন্দির সংলগ্ন এলাকাতেই রয়েছে বিরাট একটি পুকুর, জনশ্রুতি অনুযায়ী এই পুকুরেই পাওয়া গিয়েছিলো দেবী সতীর খণ্ডিত অঙ্গ। পুকুরটি বর্তমানে কুন্ডপুকুর নামেই পরিচিত। শোনা যায় কোম্পানি আমলে এই মন্দিরের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল, য়ুরোপীয় সাহেব মেমরাও আসতেন পুজো দিতে, বহু বিদেশী বিদেশিনী এই কালীঘাট ও তার সংলগ্ন অঞ্চলকে স্থির করে রেখেছেন তাদের ইজেলে যেগুলি আজকেও ইতিহাসের প্রামাণ্য নথি হয়ে।