কাবুলিওয়ালার দেশের গল্প

"তোমার ঝুলিতে কি আছে বলোনা গো? -হাথি আছে হাথি! -দূর বোকা ঝুলিতে কি হাতি থাকে নাকি? দেখেছো বাবা কি বোকা বলছে ওর ঝুলিতে হাতি আছে"

  নিশ্চয়ই মনে করতে পারছেন চলচ্চিত্রের দৃশ্যটি, রবিঠাকুরের ছোটোগল্প কাবুলিওয়ালা কে সার্থকভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন প্রবাদপ্রতীম চলচিত্রকার তপন সিংহ, শুধুমাত্র কিছু রোজগারের আশায় অসংখ্য সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ সুদূর কাবুল মুলুক থেকে পাড়ি দিত ভারত দেশে, জানেন কি সে কাবুলিওয়ালার দেশের ইতিহাস?  প্রাচীনকাল বা আদি ঐতিহাসিক সময়কালের কিছু পর অবধিও আফগানিস্তান ছিল ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বী এবং বহু উপজাতির মানুষদের বাসভূমিআফগানিস্তান নামটির আসল অর্থ ঐক্যবদ্ধ উপজাতিদের দেশ, বৈদিক ঐতিহ্যে আফগানিস্তানে বসবাসকারী "পখত" উপজাতির নাম উল্লিখিত হয়েছিল। বর্তমান আফগানিস্তানের জাতীয় সংগীতটিও হয়তো এই অর্থের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই রচিত হয়েছে। আফগানিস্তানের জাতীয় সংগীত 'মিললি সুরোদের' বঙ্গানুবাদ করলে তার অর্থ হয় 'এই ভূমি আফগানিস্তান, এ সব আফগানের ইজ্জত', শান্তির ভূমি, তরবারির ভূমি, এর প্রত্যেক সন্তান সাহসী, এ সব জাতির দেশ, ব্যালেক এবং উজবেকদের ভূমি, পশতুনদের এবং হাজারাদের, তুর্কমেনীদের এবং তাজাকদের, তাদের সঙ্গে রয়েছে আরবি এবং গুজারা, পামিরিরা, নুরিস্তানিরা, ব্রাহুইরা এবং কিযিলবাশরা, এইমাকরা এবং পাশাইরা, এই ভূমি সর্বদা উজ্জ্বল থাকবে, নীল আকাশে সূর্যের মত, এশিয়ার বুকের ওপর, আর  সব সময়ের জন্য হৃদয় হয়ে থাকবে, আমরা এক ঈশ্বরকে আমরা অনুসরণ করবো,আমরা বলি, আল্লাহ্‌ মহান, আমরা বলি, আল্লাহ্‌ মহান,আমরা বলি, আল্লাহ্‌ মহান। অনেক ঐতিহাসিক এবং কল্পনাবিলাসীর দল ভাবতে থাকেন এবং মনে করেন যে আফগানিস্তান এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মিলিয়েই একদিন প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল কিন্তু সেইরকম ভেবে নেওয়ার কোনোরকম ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বললেই চলে কারণ মানুষ তার সুবিধে অনুযায়ী অনুকূল পরিবেশ অনুযায়ী নিজেদের বাসস্থান খুঁজে নিতে চেষ্টা করেছিল এবং সেই ভাবেই এগিয়েছিল সভ্যতার ধারা।

   প্রাচীনকালে বর্তমান সময়ের মতো দুটি ভূখণ্ডের মাঝে থাকতনা কোনো কাঁটাতারের বেড়া, তাই খুব সহজেই হতে পারতো বিভিন্ন সংস্কৃতির আদানপ্ৰদান মত বিনিময়, সীমারেখা অবশ্যই ছিল বিভিন্ন শাসকদের অধিকৃত অঞ্চলের কিন্তু তার বাধা তেমন ছিলোনা বলেই অনায়াসে গান্ধার এর রাজকন্যা হয়ে উঠেছেন এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র অথবা গান্ধারের গ্রীকবৌদ্ধ শিল্পকলা হয়ে উঠেছে ভারতীয় শিল্প ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গান্ধার শহরটি বর্তমানে কান্দাহার নামেই আফগানিস্তান এবং পৃথিবীর মানুষদের কাছে পরিচিত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে কুশানরা আফগানিস্তানের শাসনকর্তা ছিল। বৌদ্ধধর্মই ছিল এখানকার প্রধান ধর্ম। এই সময়কালের অনেক বৌদ্ধস্থাপত্য ও শিল্পকলার ধ্বংসাবশেষ আজও আফগানিস্তানে লক্ষ্য করা যায়। হুনদের আক্রমণে কুশানদের পতন ঘটার পরেও প্রায় মধ্যযুগের সূচনাকাল অবধিও কাবুলদেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারীদেরই আধিপত্য ছিল, অলবেরুনীর রচনা এবং প্রত্নতাত্বিক উৎ্খনন থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, দেবমূর্তি ও শিলালিপি তারই সাক্ষ্য দেয়। এরপর গজনীর সুলতান মাহমুদ ৯৯৮ থেকে ১০৩০ সাল অবধি আফগানিস্তান শাসন করেন এবং তাঁর সময়েই সমগ্র আফগানিস্তান ইসলাম অধুষ্যিত হয়। সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর গজনীর প্রভাব হ্রাস পায়, ত্রয়োদশ শতকে মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ মোঙ্গোল চেঙ্গিস খান আফগানিস্তান দখল করেন। চতুর্দশ শতকের শেষদিকে তৈমুর লং আফগানিস্তান দখল করেন। মোঘল সম্রাট বাবর ছিলেন পিতৃকূলের দিক থেকে তৈমুর লঙের আর মাতৃকুলের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর, ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাবর কাবুল দখল করেন, তারপর ভারতবর্ষে  মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী আফগানিস্তান একটি গণতান্ত্রিক দেশ, ১৯৭৩ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই আফগানিস্তানে প্রজাতন্ত্রের সূচনা ঘটে।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...