বিপত্তারিণী ব্রতের উপাখ্যান

বিদর্ভ দেশে এক ন্যায়বান রাজা ছিলেন। তাঁর ছিলেন এক নিষ্ঠাবতী রানি। ধর্মে-কর্মে রানির গুণপনার শেষ ছিল না। 


অন্তঃপুরে রানির ঠাকুরঘর। সেখানে অধিষ্ঠিতা ছিলেন দেবী দুর্গা। রানি নিজের হাতে নিত্য দেবীস্থান মার্জনা করতেন, ফুল তুলতেন, পূজার আয়োজন করতেন আর তিন বেলা দীপ-ধূপ দিয়ে পুজো করতেন। 

আর কী করতেন রানি? অবসরে অরণ্যযাত্রী মহারাজের নৈমিত্তিক শিকার-সঙ্গী হতেন। সে-বার অরণ্যে শিকারে গিয়েই ঘটল এক মারাত্মক কাণ্ড। 

সে-বার হল কী, হরিণের পিছু ধাওয়া করতে করতে সৈন্যদল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দূরে চলে গেল রাজা ও রানির রথ। তাঁরা পথ হারিয়ে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা যেখানে হাজির হলেন, সেখানে সৈন্যদের কোলাহল সামান্যও শোনা যাচ্ছিল না।


রাজার রথ এগিয়ে চলল। দুপুর গড়িয়ে গেল, তবুও কারও চিহ্ন পাওয়া গেল না।


আসলে, সুগভীর অরণ্যের গোলকধাঁধায় রথ সেই একই জায়গায় বার বার চক্কর কাটতে লাগল। ইতিমধ্যেই রথের ঘোড়ারা তেষ্টায় ক্লান্ত, রানি অনেকক্ষণ আগেই তৃষ্ণার কথা বলেছেন, এখন তাঁরও ছাতি ফাটছে। কিন্তু, কাছে-পিঠে কোথাও একটা জলা বা জলাশয়ের চিহ্নমাত্রও নেই।

রানি না-বুঝলেও বিপদটা এতক্ষণে রাজা বুঝেছেন। বুঝেছেন, গোলকধাঁধায় পড়েছেন। বেরুতে না-পারলে মৃত্যু নিশ্চিত। তাছাড়া এখানে অরণ্য এতটাই গভীর যে আকাশ দেখা যায় না। তাই দিন বা রাতে নক্ষত্রের অবস্থান দেখে পথ খুঁজে নেওয়ারও কোন আশা নেই। 

Bipattarini1

হঠাৎ রথ থেমে গেল। একবুক তেষ্টা নিয়ে ঘোড়াদের পা বুঝি আর চলছে না, তারা স্থির হয়ে গেল। রানি এলিয়ে পড়েছেন। রাজাও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন। এভাবেই তাহলে অসহায়-মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে শেষ পর্যন্ত! বেশ।

কতক্ষণ যে কেটে গেল তার ইয়ত্তা নেই। আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করে রাজা অবসন্ন। এমন সময় মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতায় ভারি মচ মচ শব্দ শোনা গেল। দূর থেকে সেই শব্দ ক্রমে কাছে এগিয়ে আসছে!

অনেক কষ্টে রাজা বন্ধ দু'চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলেন শব্দের উৎস। আধখোলা আবছা চোখে শুধু দুটি ছায়ামূর্তিকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখলেন। তারপরই জ্ঞান হারালেন।

যে-দুজন ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল তারা হল ব্যাধ আর ব্যাধিনী। তারা কয়েকটা বুনো খরগোশ শিকার করে পিঠে ঝুলিয়ে কুটিরপানে ফিরছিল। রথটিকে এখানে এই অবস্থায় অবস্থান করতে দেখে তারা প্রথমটায় অবাক হল। তারপর এগিয়ে এসে অচেতন রাজারানিকে আবিষ্কার করল। আসল ঘটনাটা অনুমান করতে তাদের অসুবিধে হল না। 

তাই রাজারানিকে কাঁধে তুলে অনেক পথ হেঁটে তারা নিয়ে এল নিজেদের কুটিরে। জল ছিটিয়ে চেতন করল। ফলমূল খাইয়ে সুস্থ করল। তারপর পৌঁছে দিল সৈন্যদের কাছে। 

কৃতজ্ঞ রাজারানি ব্যাধ ও ব্যাধিনীকে কতশত ধনসম্পদ দিতে চাইলেন। কিন্তু, তারা বনের মানুষ। বনের মধু, বনের ফল, শিকারের মাংস খেয়ে নিতান্তই সাধারণ কাটায়। তারা নির্লোভ। কিছুই নিতে চাইল না। 


তখন রাজারানি তাদের সঙ্গে 'মিতালী' পাতালেন, 'সই' পাতালেন। তারপর রাজপুরীতে ফিরলেন।


ব্যাধিনী বনের ফুলটা, মধুটা যখন যা ভালো পায়; মাঝে মাঝে তা-ই নিয়ে এসে সই-রানিকে দিয়ে যায়। আর রানিকে মনের কথা, বনের কথা, শিকারের কথা সব বলে যায়। রানির সে-সব শুনতে খুব ভালো লাগে।


তারই মধ্যে একদিন, ব্যাধিনীর মুখে রানি এক নিষিদ্ধ পশু শিকারের কথা শুনলেন। শুনলেন সেই মাংসের সুস্বাদের কথা। 


ব্যস, রানির খুব লোভ হল। ইচ্ছে হল সেই মাংস খাবার। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে যে, রাজা যদি এ-মাংস খাবার কথা জানতে পারেন, তাহলে নির্ঘাত গর্দান নেবেন। কিন্তু এমন জ্বালা যে, লোভজাত ইচ্ছেটাকে রানি কিছুতেই দমন করতে পারলেন না! না না করেও তাই শেষ পর্যন্ত ব্যাধিনীকে বলেই ফেললেন সেটা আনার কথা।


সইয়ের ইচ্ছেপূরণ বলে কথা। ব্যাধিনী তাই পরদিনই রান্না করা মাংস রানির কাছে গোপনে পৌঁছে দিয়ে গেল। 


বনের মানুষের কোনকিছুতেই লুকোছাপা থাকে না। তাই রানির কথায় আনাড়ির মতো লুকিয়ে ব্যাধিনী যখন মাংস আনছিল, তখন তাকে দেখে সন্দেহ হল রাজার চরের। সে তাকে অনুসরণ করেই পেয়ে গেল নিষিদ্ধ মাংসের খবর। ব্যস, অমনি গিয়ে তুলল তা রাজার কানে।

খবর পেয়ে রাজা তো রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। অমনি তলব করলেন রানিকে। ছুটতে ছুটতে রানিও হাজির হলেন তাঁর কাছে। তখন রাজা হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, শুনলাম তুমি নাকি ওই ব্যাধিনীকে দিয়ে নিষিদ্ধ মাংস আনিয়েছ!

কথাটা শুনেই রানির বুক ভয়ে ধড়াস করে কেঁপে উঠল। তবে তিনিও রাজার মেয়ে, সহজে ধরা পড়ার পাত্রী নন। তাই নিজেকে যথাসম্ভব সহজ রেখে অস্বীকার করে বললেন, মহারাজ এ-সংবাদ আপনাকে কে দিয়েছে আমি জানি না। তবে, আপনি তো জানেন সই আমায় বনের ফল মাঝে মাঝেই দিয়ে যায়, আজও তাই দিয়েছে।

রাজা আবার হুঙ্কার ছাড়লেন, আমার প্রমাণ চাই, প্রমাণ! তোমার কথা যদি মিথ্যে হয়, তাহলে তোমার আর ব্যাধিনী--দুজনেরই গর্দান যাবে। এক্ষুনি, নিয়ে এসে দেখাও কী এনে দিয়েছে সে!

রানি ছুটতে ছুটতে প্রথমে এলেন ঠাকুর ঘরে। কাঁপতে কাঁপতে মা দুর্গার পায়ে হত্যে দিলেন। মাথা ঠুকতে ঠুকতে আকুল হয়ে বার বার বলতে লাগলেন, হে মা বিপত্তারিণী দুর্গে, আমি ভুল করে ফেলেছি মা, আমায় এ-বারের মতো এ-বিপদ থেকে উদ্ধার করে দাও মা, আর কক্ষনো এমন ভুল করব না! আমায় উদ্ধার কর মা, আমি সারাজীবন তোমার ব্রত করব!

রানির এমন ব্যাকুল প্রার্থনায় দেবী প্রসন্ন হলেন। আবির্ভুত হয়ে রানির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ওঠ মা। তুমি লোভের বশে ভুল করেছ। লোভের বশেই মানুষ ভুল করে। নিষিদ্ধ ভোগের জন্য লালায়িত হয়, নিষিদ্ধ বস্তুকে পাবার জন্য হাত বাড়ায়। তাতেই পাপ হয়। পাপ মৃত্যুকে ডেকে আনে। তাই লোভকে জয় করতে শেখো। এই শিক্ষা নিজেকেই অর্জন করতে হয়।

দেবীকে সাক্ষাৎ দর্শন করে রানির আনন্দের অন্ত রইল না। কৃপা পেয়ে দেবীর পা চোখের জলে ধুয়ে তিনি বার বার প্রণিপাত করতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন, 'আমি সারাজীবন তোমার ব্রত করব মা, শুধু এ-বারটির মতো আমায় উদ্ধার কর গো মা!' 

দেবী তাঁকে তুলে শান্ত করে বললেন, বাছা, তুমি আমার কৃপা পেয়েছ যখন, তখন উদ্ধারও নিশ্চিত পাবে! এই ধরালোকে 'বিপত্তারিণী' নামে তুমিই প্রথম আমায় সম্বোধন করলে। এই সম্বোধন আমার ভালো লেগেছে। তাই তুমি যে ব্রতের মানত করেছ, তা 'বিপত্তারিণী' নামেই করো। তাতে তোমার শুধু এ-বিপদ না, সমস্ত রকমের বিপদ কেটে যাবে। এখন যাও, কোন ভয় নেই। গিয়ে রাজাকে সেই নিষিদ্ধ মাংসের পাত্র নির্ভয়ে দাও। যাও।


দেবী অদৃশ্য হলেন। অভয় পেয়ে রানি মাংসের পাত্র নিয়ে গিয়ে রাজাকে দিলেন।


রাজা পাত্রের আবরণ সরিয়ে দেখলেন পাত্রে রানির কথামতোই বুনো ফল রয়েছে, অন্য কিচ্ছুটি নেই। আর রানি দেখলেন, দেবীর কৃপা!

দেবীর কৃপায় রাজা শান্ত হলেন। রানির বিপদ কাটল। তখন রানি মহা-আড়ম্বরে বিপত্তারিণী ব্রতের সূচনা করলেন। ব্রতের মাহাত্ম্য রাজ্যময় প্রচার করলেন। এভাবেই ক্রমে রাজার অন্তঃপুর থেকে তাঁর দেখাদেখি বিপত্তারিণী ব্রতের ধারা ছড়িয়ে পড়ল সাধারণের ঘরে ঘরে, যা আজও প্রবাহিত হয়ে চলেছে বংশপরম্পরায়...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...