"আহ্লাদে আটখানা সাতেপ্যাঁচে নেই মাঝখানে যেই জন পথ পাবে সেই, শঙ্খে চক্রে আছে পদে পদে ভর, পারিজাত ভর করে যাও পাতালঘর”, কি? মনে পড়ছে লাইন গুলো? শির্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় রচনা পাতালঘরের পুতুলগুলোকে বলা হতো আহ্লাদি পুতুল, ওই পুতুলগুলো সত্যি আহ্লাদি ছিল কিনা তা জানা নেই কিন্তু ওরকম অনেক পুতুলই যে বাড়িতে বাড়িতে অনেক আহ্লাদিকে মন ভুলিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ ধরে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। এই পুতুল বাংলার সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যে মানুষ একদিন বাইসন এঁকেছিল আলতামিরায় কিংবা ময়ূর এঁকেছিল ভীমবেটকায়, নব্যপ্রস্তর যুগের শেষে সেই মানুষই তার নিজের হাতে পুতুল গড়ে তুলেছিল।
বর্ধমান জেলার দুটি তাম্রপ্রস্তর যুগীয় প্রত্নক্ষেত্র পাণ্ডুরাজার ঢিবি এবং মঙ্গলকোট থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির পুতুল গুলি অথবা উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপার কাছেই চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত চাকা লাগানো খেলনা গাড়িগুলি বাংলার প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করে। বাংলার অন্যান্য প্রত্নক্ষেত্র থেকেও প্রচুর পোড়ামাটির খেলনা পুতুল আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলার সভ্যতা ছিল প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক এবং কৃষিভিত্তিক, এবং সেই জীবনধারার ফসলই হলো বাংলার পুতুল। বাংলার বিভিন্ন মন্দিরের থানে উৎসর্গ করার জন্য বা মেলায় বিক্রীর জন্য যে টেপা মাটির পুতুল পাওয়া যায় তা এই বাংলার আদিম সংস্কৃতির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটায়। এই পুতুলগুলির বিষয় সাধারণত মাতৃকা, তবে হাতি ঘোড়া পাখি মাছ প্রভৃতির রঙিন পুতুলেরও দেখা মেলে। এই পুতুলগুলি সাধারণত সন্তান কামনায় মন্দিরে মন্দিরে উৎসর্গ করা হয়।
এই ধরনের দৈবীপুতুলের পাশাপাশি ছোটদের খেলার জন্যেও তৈরী হয় নানারকম পুতুল। এই পুতুলগুলির মাধ্যমেই মানুষ চেয়েছিলো কাদামাটির ওপরে নিজের হাতের স্পর্শে নিজেরই আত্মপ্রতিকৃতি তুলে ধরতে। কখনো এক খোল ছাঁচ কখনো দুখোল ছাঁচ কখনো কুমোরের চাকের তৈরী করা হতো পুতুল, বর্তমানেও মেদিনীপুরের মির্জাবাজার কিংবা মুর্শিদাবাদের কাঁঠালিয়াতে এই একই পদ্ধতির ব্যবহার করে দেওয়ালি পুতুল তৈরি করা হয়। সারাদিন সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন মা আর তার সাথে সামলাতে হচ্ছে আঁচল এ খুঁট ধরে থাকা সন্তানটিকেও, আর সেই সন্তানটি মন ভোলানোর জন্যে দরকার কোনো জাদুকাঠির, এই ভাবনা থেকেই আস্তে আস্তে তৈরি হয় মাটির পুতুল, চাকা লাগানো গাড়ি, ঝুমঝুমির, পরবর্তী কালে মাটির সাথে কখনো কাঠ, তালপাতা, গালা বা অন্যান্য ভেষজ দ্রব্যও মিশ্রিত করা হতে থাকে| দিব্যি চলছিল মাটির খেলনা গাড়ির যাত্রাপথ, কিন্তু গোল বাধলো ইংরেজরা ভারতে আসার পর, মাটির খেলনা জায়গা কেড়ে নিলো চিনেমাটি বা পোর্সেলিনের তৈরি খেলনা। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিদেশী খেলনা আমাদের শিশুদের মন দখল করে বসে থাকলেও আজও বেঁচে আছে হাতের তৈরি মাটির পুতুল, তাই ছাতু বাবুর বাজারে চড়কের মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হয়তো আপনার চোখে পড়ে যাবে ঘাড় নাড়া মাটির পুতুলের কিংবা নন্দনে ঘুরতে ঘুরতে দেখবেন একজন ফেরিওয়ালা হেঁকে বেড়াচ্ছে তালপাতার সিপাই নেবে তালপাতার? আপনার মন ফিরে যাবেই শিকড়ের টানে।