বটতলার গল্প

বই তো পড়ো টই পড়ো কি ? পড়ো নিশ্চই, ঘুরে বেড়াও কলেজ স্ট্রিটের আনাচে কানাচে, কিন্তু পুরোনো কলকাতায় কিন্তু এই কলেজ স্ট্রিট নয় বইপাড়া ছিল অন্য কোথাও, শোভাবাজার এলাকার এক বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন কলকাতার বইপাড়া। এই বটতলা এলাকায়  যে মুদ্রণ  শিল্প গড়ে উঠেছিল, তা  ছিল অতি সাধারণ পাঠকদের জন্যেই। নিম্নরুচির যৌন রসাত্মক বই, কিছু পুঁথি, দেব দেবীর পাঁচালি, পঞ্জিকা ইত্যাদি  প্রভৃতি প্রকাশিত হতো বটতলা থেকে। খ্যাতনামা লেখকেরা  বটতলার বই বা সাহিত্য কে ব্যঙ্গ করেছেন, বাদ যাননি স্বয়ং বঙ্কিমও তবুও তৎকালীন সময়ে যে বটতলার গুরুত্ব এবং গ্রহণযোগ্যতা দুইই  ছিল তা বোধহয় কেউই অস্বীকার করতে পারেননি। বটতলার পুঁথিকারেরা ব্যবসায়িক লাভের কথা ভেবেই এমন প্রকাশনা করতেন যার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সাধারণ মানুষদের কাছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অধিকাংশ বাংলা বই, ছাপাই চিত্র ইত্যাদি এই বটতলা থেকেই প্রকাশিত হতো। বই এর মধ্যে চিত্র সংযোজন এবং বিভিন্ন  অলঙ্করণ-এর ব্যবহার যে বটতলার দান তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। ইউরোপের পুস্তকে  চিত্র সংযোজন বা ইলাস্ট্রেশন এর ব্যবহারের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একই আঙ্গিকের ছবির ব্যবহারের  মাধ্যমে বটতলার শিল্পীরা বই কে সাজিয়ে তুলতেন। 

দেবদেবী আর পৌরাণিক কাহিনীর ছবি ক্রেতাদের কাছে ছিল ভীষণ জনপ্রিয়সুকুমার সেন তার ‘বটতলার বই’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘সেকালে অর্থাৎ আজ থেকে দেড়শ বছরেরও বেশি কাল আগে শোভাবাজার কালাখানা অঞ্চলে একটা বড় বনস্পতি ছিল। সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় তখনকার পুরবাসীদের অনেক কাজ চলত। বসে বিশ্রাম নেওয়া হত। আড্ডা দেওয়া হত। গানবাজনা হত। বইয়ের পসরাও বসত। অনুমান হয় এই বই ছিল বিশ্বনাথ দেবের ছাপা, ইনিই বটতলা অঞ্চলে এবং সেকালের উত্তর কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা খুলেছিলেন, বহুকাল পর্যন্ত এই ‘বান্ধা বটতলা’ উত্তর কলকাতায় পুস্তক প্রকাশকদের ঠিকানা চালু ছিল .... ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ছোট সস্তার প্রেস গড়ে ওঠে। এগুলির চৌহদ্দি ছিল দক্ষিণে বিডন স্ট্রিট ও নিমতলা ঘাট স্ট্রিট, পশ্চিমে স্ট্র্যান্ড রোড, উত্তরে শ্যামবাজার স্ট্রিট এবং পূর্বে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট”। বটতলার বই গুলির জনপ্রিয়তার আর একটি কারণ ছিল বটতলার বইয়ের  বিজ্ঞাপন। সাধারণ নিম্ন বা মধ্য রুচি ও মেধার মানুষের সঙ্গে উচ্চ মেধার পাঠককেও একই সঙ্গে আকৃষ্ট করাই  ছিল এই বিজ্ঞাপনগুলির প্রধান উদ্যেশ্য। বলতে গেলে বটতলা হয়ে উঠেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির মাস পিপল এর রুচি আর টেকনোলজির একটি সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ধীরে ধীরে বটতলার প্রকাশনার চাহিদা কমতে থাকে। বিংশ শতাব্দীতে প্রগতিশীল 'ভদ্রলোক' বাঙালিদের কাছে বটতলা হয়ে ওঠে নিম্নমেধা এবং নিম্নরুচির পরিচায়ক। রুচিসম্পন্ন বাঙালিদের কাছে বটতলা হয়ে ওঠে ঘৃণা বা অবজ্ঞার পাত্র। তবে তৎকালীন সময়ে বা বর্তমানে বটতলা শিক্ষিত বাঙালিদের কাছে যতই হাস্যকর বা নিন্দনীয় হোক না কেন এই বাংলার দেশীয় মুদ্রণ শিল্প যে ভিতের ওপর দঁড়িয়ে রয়েছে তা যে নিঃসন্দেহে বটতলার দান একথা চোখ বন্ধ রেখেই বলা যায়।  

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...