ঋতুবদলের সঙ্গেই বদলাত ডিগ্রি
কুড়ি রকমের ডিগ্রি ঝুলছে কাঁধে।এগারোটা আলাদা বিষয়ের উপর রয়েছে স্নাতকোত্তর উপাধি।
৪২টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। মাত্র ৪৯ বছরের জীবনে একাধারে চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা, কূটনীতিক, চিত্রগ্রাহক, অভিনেতা, চিত্রকর সহ দেশের সর্বকনিষ্ঠ এম এল এ।
পাড়ার পচা, বিশু, সুবোধ আর গোপালেরা আজও পালা করে বাগদেবীর আরাধনায় ব্যস্ত।ফি বছরই পরীক্ষার খাতায় দুটো করে নবীন চন্দ্র সেনের রসগোল্লা বরাদ্দ ।অথচ বিদ্যা দেবীকে তুষ্ট করতে কোনও ভুল! নৈব নৈব চ।তবুও রা নেই দেবীর।
১৯৫৪ সালে মহারাষ্ট্রে জন্মানো এই ব্যক্তির পসারই আলাদা। মা সরস্বতী যেন তল্পিতল্পা সহ তাঁর মগজে অধিষ্ঠাত্রী।
তিনি শ্রীকান্ত জিচকার। শিক্ষার সব ক্ষেত্রে যাঁর অবাধ আনাগোনা। জ্ঞানপিপাসু শ্রীকান্ত ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিতদের একজন বলে গণ্য।
এই রোমাঞ্চকর শিক্ষা যাত্রার শুরু এম বি বি এস পাঠ গ্রহন দিয়ে। সেটাই ছিল প্রাথমিক পাখির চোখ। তীর বিঁধে গেলে গোচরে আসে ভিতরের অন্য ডাক। অন্য বিষয়গুলোও তখন ডাকছে বিদ্যার এই ছত্রধারী কে।
শিক্ষা যেন নিজেই নিজেকে সঁপেছেন তাঁর হাতে। তাঁকে এগিয়ে আসতে হয়নি। বুঝেছিলেন ডাক্তারির পাঠ তো হল; কিন্তু অন্য অনেক বিষয়ও যে ডাকছে। শুরু হল এগোনো।
শিক্ষা অসীম সমুদ্রের মত। তার শেষ হয় না, হয় শুধুই বিস্তার, আরও সামনে এগিয়ে; জলও বাড়তে থাকে ততই। আর ভয়ের উল্টো পারেই তো জয় অপেক্ষমান।
সাংবাদিকতা থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান হয়ে রাজনীতি- কৃতিত্বের ছাপ ছেড়েছেন সর্বত্রই।
এম বি বি এস-এর পর এম ডি ডিগ্রি নিয়ে পুরোদস্তুর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া।এরপর আইনের ওপর ‘এল এল বি’ ডিগ্রি নিয়ে ফেললেন। আন্তর্জাতিক আইনের ওপর স্নাতকোত্তর ‘এল এল এম’ ডিগ্রি নিয়ে এবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে হয়ে যাওয়া বিশেষজ্ঞ আইনজীবী।
সমাজের দুটো অভিজাত পেশায় যুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেও পেশাগত জীবনে প্রবেশ না করে তিনি একের পর এক ডিগ্রিই নিয়ে গিয়েছেন। চিকিৎসাবিদ্যা, আইনের পর তিনি এলেন ব্যবসা শিক্ষার দুনিয়ায়।
ব্যবসা-ব্যবস্থাপনার ওপর ডিপ্লোমার সাথে এম বি এ করে ফেললেন এই অতিমানবীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি দারুণ ছবি তুলতে পারতেন এবং অসাধারণ বক্তা ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকতার পাঠের প্রতি বাড়তি ঔৎসুক্য ছিলো তাঁর। দেরি না করে সাংবাদিকতায় একটা ব্যাচেলর ডিগ্রিও নিয়ে ফেললেন শ্রীকান্ত।
তেল এখনও ফুরোয় নি। চিকিৎসাবিদ্যায় এম ডি, আন্তর্জাতিক আইনে এল এল এম ও ব্যবসা-ব্যবস্থাপনায় এম বি এ ছাড়াই এই ব্যক্তির স্নাতকোত্তর ডিগ্রিই আছে আরও ১০ টি বিষয়ের ওপর।
লোকপ্রশাসন, সমাজবিজ্ঞান,অর্থনীতি,সংস্কৃত,ইতিহাস,ইংরেজি,দর্শন,রাষ্ট্রবিজ্ঞ,চীন ও ভারতীয় ইতিহাস,সংস্কৃতি,পুরাতত্ত্ব, ও মনোবিজ্ঞান।
প্রত্যেকটিতে প্রথম শ্রেণী তো পেয়েছেনই, অধিকাংশ বিষয়েই পেয়েছেন প্রথম স্থান। শিক্ষাজীবনে তিনি স্বর্ণপদকই পেয়েছেন ২৮টি। পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উপর নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি- ডক্টর অব লিটারেচার।
১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা প্রতিটি গ্রীষ্ম ও শীতে ৪২ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কোনও না কোনও পরীক্ষায় বসেছেন- একাগ্রতার এক অন্যতম উদাহরণ!
জীবনের ২৪ টা বছর একটানা পড়াশোনার পর একসময় মতি হলো পুলিশের চাকরির। যেই ভাবা সেই কাজ। বসে গেলেন আই পি এস পরীক্ষায়। ফলাফল? কী আবার? যথারীতি সেখানেও সাফল্য। ১৯৭৮ -এর ঘটনা। দু’ বছর চুটিয়ে পুলিশের চাকরি তারপর আবার নতুন পেশার খোঁজ।
১৯৮০-তে বসলেন ভারতের সবথেকে গৌরবময় সরকারি নিয়োগ পরীক্ষা আই এ এস-এ। তবে এবারে মোটে চার মাস গড়াতে ইতি টানলেন সেই চাকরিতেও। আসলে উদ্যেশ্য তার ভাষা পাচ্ছেনা।
লক্ষ্য এবার সমাজসেবা। কংগ্রেসের হয়ে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে লড়বার টিকিট , বয়স তখন ২৫। হয়ে গেলেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক বা এমএলএ।
না, ক্ষান্ত থাকেননি সেখানেও। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে বিধায়ক থাকার পর ১৯৮৬-তে দ্বিতীয় মেয়াদে এসে তিনি হন মহারাষ্ট্রের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য। প্রাথমিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকলেও একই সময়ে সামলেছেন ১৪ টা মন্ত্রণালয়ের গুরুদায়িত্ব!
সুনিপুণ দক্ষতায় সেই দায়িত্বও সামলেছেন ১৯৯২ সাল অবধি। এরপর ১৯৯২ সালে নির্বাচনে জিতে ৪ বছর রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ।
কূটনীতির বিশ্বমঞ্চেও দেশের আশা ভরসা তিনি। ইউনেস্কো ও জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেছেন জিচকার।
প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ও পেশার বাইরে ছোটবেলা থেকে যে কাজটি ভালোবেসে করেছেন, তা হলো ছবি আঁকা। মঞ্চ ছিল তাঁর আগ্রহ ও ভালোবাসার আরও এক জায়গা। অভিনেতা হিসেবে সেই মঞ্চেও রেখেছেন উজ্জ্বল উপস্থিতি।
বাগ্মী হিসেবে তাঁর অপরিমেয় খ্যাতি ছিলো। পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখেছেন ও গণবক্তা হিসেবে কথা বলেছেন জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প ও ধর্ম বিষয়ে।
জ্যোতিষশাস্ত্রের পাশাপাশি পৌরোহিত্যেও পারদর্শিতা ছিলো তাঁর। পৌরোহিত্যের কৃতিত্বের জন্য তিনি ভূষিত হন ‘দীক্ষিত’ উপাধিতে।
যাঁর মনে প্রানে শিক্ষার টান, তাঁর সংগ্রহে বই থাকবেনা, তা কেমন করে সম্ভব? হ্যাঁ, অভাব রাখেননি সেখানেও। আজীবন এর সঞ্চয় প্রায় ৫২০০০ বই বর্তমানে নাগপুরের এক পুস্তক সংগ্রহালয়ে শোভা পাচ্ছে; তাঁর নামাঙ্কনেই।
১৯৮৩ সালে বিশ্বের সেরা ১০ উদ্যমী তরুণ-এর একজন নক্ষত্র শ্রীকান্ত।লিমকা বুক অব রেকর্ডস অনুযায়ী শ্রীকান্ত জিচকার হলেন ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি। অনেকের মতে, তাঁর এ কৃতিত্ব শুধু ভারতেই নয়, বরং বিশ্বমঞ্চেও অদ্বিতীয়।
অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটির বর্ণময় জীবনের আলপনা ঘেঁটে যায় ফ্যাকাশে রঙের ছোঁয়ায়।২০০৪ সালের ২ জুন। বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগামী ট্রাক শ্রীকান্তের গাড়িকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলে মৃত্যু ঘটে তাঁর। দুর্ঘটনার জন্য শ্রীকান্তের পরিবার পান ৫০.৬৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ।
অদৃষ্টের এই পরিহাস! একাগ্রতা, সংকল্পের দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস ও পাণ্ডিত্যের সাগর-এর বিশাল জলাধারের মূল্য মাত্র এই কটা অঙ্কে কি কষা সম্ভব? কী খুঁজছিলেন আর কী পেয়েছেন- সেই হিসাব –নিকাশ তাঁর অবর্তমানে পাঠক আর কী করবেন!
তবে বলা চলে, তিনি প্রকৃতই একজন উদাহরণ হয়ে উঠেছেন বটে।